“ভাই আব্দুল্লাহ! ওস্তাদ হাসান নিজের সহকারী নিযুক্ত করার ব্যাপারে গতকাল যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন এ ব্যাপারে তোমার অভিমত কি?”
বিশাল বপু ও অনেক পাণ্ডিত্যের অধিকারী এক ব্যক্তি দৃশ্যত সরল সোজা অপর এক ব্যক্তির কাছে বসে তাকে প্রশ্ন করেন।
“শাইখ ইমাদ! এ ব্যাপারে আবার আমার মতামত কি হবে? আপনি তো প্রস্তাব করেছিলেন , হাসানুল বান্নার উচিত নিজের একজন সহকারী নিয়োগ করা।”
শাইখ ইমাদ বলেন, হ্যাঁ, তাতো ঠিক! আমি ইখওয়ানের স্বার্থেই এ প্রস্তাব দিয়েছিলাম। ওস্তাদ হাসানুল বান্না যদি আকস্মিক বদলী হয়ে যান তাহলে ইসমাইলিয়ায় বিস্তার লাভ করা আন্দোলনের কাজ তিগ্রস্ত হবে। তার এ দায়িত্ব বহনের জন্য অবশ্যই কোনো সহকারী নিয়োগ প্রয়োজন। কিন্তু একই সাথে একথাও সত্য যে, এ বোঝা বহন করার মত যোগ্যতা সেই সহকারীর থাকতে হবে।
ভাই আব্দুল্লাহ জিজ্ঞেস করেন, শাইখ আল জাদাওয়ীর মধ্যে কিসের ঘাটতি রয়েছে?
তিনি একজন পুণ্যবান ও নিষ্ঠাবান ব্যক্তি। তিনি শুরু থেকেই ইখওয়ানের সাথে সম্পৃক্ত। শাইখ ইমাদ শীতল নিশ্বাস ছেড়ে বলেন, আমি কি তাকে মন্দ বলেছি! কিন্তু ভাই, খোদাভীরুতাই যথেষ্ট নয়। একজন নেতার জন্য প্রয়োজন পাণ্ডিত্যের গভীরতা, গ্রহণযোগ্য আচরণ ও ব্যক্তিত্ব, এর সাথে কর্মসম্পাদনের যোগ্যতা ও দতা অবশ্যই প্রয়োজন। তুমি কি মনে করো এই কাঠ মিস্ত্রির পুত দল পরিচালনার প্রয়োজন পূরণে সম হবে? এর পর থেকে যায় নিষ্ঠার বিষয়টি। দলের স্বার্থে আমি কি আত্মত্যাগ কম করেছি? আন্দোলনের জন্য আমি অর্থও ব্যয় করে থাকি। আমি নিজের ধন সম্পদ, নিজের জীবন, নিজের ভবিষ্যৎ, সব কিছুই ওস্তাদ হাসানুল বান্না ও আন্দোলনের জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছি। কিন্তু আলী আল জাদাওয়ী এসব কাজের কোনটি করতে পেরেছেন? প্রকৃতপে তিনি কিছুই করতে পারেননি। তিনি সম্পদ ও ব্যয় করেননি কিংবা কৃচ্ছ্র সাধনাও করেননি। এতদ সত্ত্বেও হাসানুল বান্না এমন একজন একান্ত নিষ্ঠাবান সাথীকে রেখে সর্বশক্তি নিয়োগ করে কেনো এমন ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করেন যিনি আমার চেয়ে অধিক নিষ্ঠাবান নন। এটি পরিষ্কার ও সুস্পষ্ট অন্যায়। ভাই আব্দুল্লাহ বলেন , হে শাইখ! ওস্তাদ আল বান্না বিশেষ কোনো যোগ্যতা দেখেই হয়তো আলী আল জাদাওয়ীকে নিজের সহকারী নিযুক্ত করেছেন।
শাইখ ইমাদ এদিক ওদিক তাকিয়ে খুব নিচু আওয়াজে বলেন, ভাই! আমরা দ্বীনদার লোকেরা খুব সহজ সরল হয়ে থাকি। তুমি কি জানো ওস্তাদ হাসানুল বান্না কেনো এ ধরনের একজন লোকের নাম প্রস্তাব করেছেন? আব্দুল্লাহ শাইখ ইমাদের দিকে তাকিয়ে সরলভাবেই বলে ফেলেন, মাননীয় শাইখ আপনার মত জ্ঞানীগুণী মানুষের সামনে আমার কি বক্তব্য থাকতে পারে?
শাইখ ইমাদ বলেন, প্রকৃতপে ওস্তাদ আল বান্না সহকারী নিয়োগের েেত্র এমন ব্যক্তিকে বেছে নিয়েছেন যিনি তার সামনে দ্বিমত পোষণের সাহস দেখাতে পারবেন না। আব্দুল্লাহ বলেন, শাইখ! বাজে ধারণা পোষণ করা আমাদের উচিত হবে না। শাইখ ইমাদ বলেন, ভ্রান্ত ধারণার পথ তো তিনি খুলে দিয়েছেন। সাধারণ পরিষদের কথাই ধরা যাক - যেখানে এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তড়িঘড়ি করে সাধারণ পরিষদের সভা ডাকা হয়েছে। সেখানে এমন সদস্যদের ডাকা হয়নি যাদের ডাকলে বৈঠকের সিদ্ধান্ত ভিন্নরকম হতে পারে।
আব্দুল্লাহ বিস্ময়াভিভূত হয়ে শাইখের দিকে তাকিয়ে বলেন আচ্ছা, তাই নাকি! তাহলে তো তারা খুব অন্যায় কাজ করেছেন। শাইখ ইমাদ আব্দুল্লাহকে তার কথায় প্রভাবিত হতে দেখে বলতে শুরু করেন, এখন আমি এটা চাই না যে দলের আরো তি হোক, যদি দলের নেতৃত্বে জ্ঞানগত দিক থেকে দুর্বল ও খোসামোদ প্রিয় লোকদের প্রভাব বেড়ে যায় তাতে পুরো দলেরই ব্যাপক তি হবে। এখন এটাই কি কম তির বিষয় যে, দল একদিকে ঋণগ্রস্ত অপর দিকে আলী আল জাদাওয়ীর জন্য ইমামতির সম্মানি তিরিশ গিনি (মিসরী পাউন্ড) নির্ধারণ করা হয়েছে। এর বিপরীতে আমি এ দায়িত্ব স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে পালন করতে প্রস্তুত রয়েছি। আব্দুল্লাহ হতাশা ও দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, মাশাল্লাহ! সুবহানআল্লাহ! আপনার মত নিষ্ঠাবান ব্যক্তিকেই তো দলের পদে বসানো যেতে পারে। জানি না, ওস্তাদ হাসানুল বান্না একথা কেনো বুঝতে পারছেন না। শাইখ ইমাদ দুঃখ ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলেন, হ্যাঁ ভাই আব্দুল্লাহ! বিষয়টি তিনিও বুঝতে পারবেন যদি আপনার মত নিষ্ঠাবান সাথীরা মিলে তার কাছে এ সমস্যাটি তুলে ধরেন। আব্দুল্লাহ বলেন, মাননীয় শাইখ! আমি আপনার সাথে আছি, অন্য সাথীদের বলে বুঝিয়ে দলে ভিড়িয়ে নেবো।
ইসমাইলিয়ার ইখওয়ানরা, পারস্পরিক ভালোবাসা, আধ্যাত্মিক একাত্মতা, নিষ্ঠা ও আল্লাহর পথে পারস্পারিক সম্পর্কের েেত্র একটি উৎকৃষ্টতম উদাহরণ। আল্লাহর পথে ঐক্য, ত্যাগ, সংগ্রামের পথে যন্ত্রণা ও কষ্ট হাসি মুখে বরণ করে নেয়ার েেত্র একের সাথে অপরের চেয়ে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাওয়াই ছিল তাদের সাধারণ অভ্যাস। ইখওয়ান সে সময় প্রশস্ত দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে নতুন প্রজন্মের শিা ও প্রশিণ, জনকল্যাণের নতুন নতুন শিা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে তখন সেখানে এমন লোকদের ও নিয়োগ দেয়া হয় যারা প্রচলিত ও প্রথাগত শিাদীায় যোগ্যতা সম্পন্ন। কিন্তু এসব ব্যক্তির আত্মিক শুদ্ধি আন্দোলন ও আন্দোলনপন্থী লোকদের মত চারিত্রিক গুণাবলী ও নৈতিক দৃঢ়তার অভাব পরিলতি হয়। এতে ইখওয়ানের মধ্যে বাড়তি ও বেহুদা উপাদানের সংযুক্তি ঘটে।
এসব শিক কর্মচারী ইখওয়ানের পরিবেশের সাথে অপরিচিত ছিলেন। ইখওয়ানের পদ পদবী ও সম্পদের প্রতি এদের লোভের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে পড়ে। ইখওয়ানের এসব সম্পদ কর্মীরা নিজেদের পেট কেটেই সংগ্রহ করেছেন,অন্যকোথাও থেকে আসেনি। আন্দোলনের মূল ল্েযর সাথে অপরিচিত এসব ব্যক্তি ভাবেন যে ছলচাতুরীর মাধ্যমে আন্দোলনের ভেতরে অগোচরে পারস্পরিক নিন্দার প্রবাহ সৃষ্টি করতে পারলে তাদের অশুভ চিন্তা সফলতা লাভ করবে। এর ফলে তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বড় বড় পদ ধনসম্পদ এমনকি মূল আন্দোলনের পদ ও পদবীতে জেঁকে বসতে পারবে এবং ইখওয়ানের ঘাড়ে বসে নির্দেশ জারি করতে পারবে।
এ ল্য বাস্তবায়নে যিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা (?) পালন করেন তিনি হলেন একজন আলেম, ফিকহ বিশেষজ্ঞ, খ্যাতিমান সাহিত্যিক, সুমিষ্ট কণ্ঠের অধিকারী বক্তা, বাকপটু ব্যক্তি শাইখ ইমাদ উদ্দীন আল আজহারি। তাকে হেরা মক্তবে শিক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল।
ইখওয়ান কর্মীরা তার যোগ্যতার মূল্যায়ন করে তাকে সম্মেলন কমিটির সভাপতির দায়িত্ব প্রদান করেন। সবাই তাকে সম্মান ও মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখতেন। এর ফলে তার খায়েশ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তিনি ইসমাইলিয়ায় দলীয় প্রধানের মসনদটি দখল করে নেবেন। তারা ভেবেছিলেন, হাসানুল বান্না সরকারি চাকুরে এবং যেকোনো সময় বদলী হয়ে যেতে পারেন।
প্রবৃত্তির এ চাহিদা পূরণে সহজতর প্রাকৃতিক বিধান এটাই হতে পারতো যে, তিনি নিজেকে একজন নিষ্ঠাবান ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত করে আন্দোলনের পথে উৎসর্গকৃত প্রাণ হবার অভিনয় করে যাবেন- যা দেখে কর্মী বাহিনী তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়বে। কিন্তু তিনি এ পথে না গিয়ে মত পার্থক্য সৃষ্টি, পর নিন্দা, পরচর্চা ও কানাকানির নিন্দিত পথ বেছে নেন। তিনি ইখওয়ানের কর্ম পরিষদের সদস্যদের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি করার চেষ্টা করেন। এদের সম্পর্কে তার ধারণা ছিল- এসব লোকজন ইখওয়ানের অভ্যন্তরে প্রভাবশালী। সুতরাং এসব সদস্যের সাথে ব্যাপক দেখা সাাৎ করে তাদের সাথে ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক বৃদ্ধির প্রয়াস অব্যাহত রাখেন। তার নিজের বাসায় ও এদের দাওয়াত দিতে থাকেন। ইখওয়ানের তৎপরতা ও প্রচেষ্টার ল্যই হলো, আন্দোলনের ডাকে সমবেত লোকদের পারস্পারিক আত্মিক ও নৈতিক সম্পর্কের বন্ধন সুদৃঢ় করা। তাই তারা শাইখের এই তৎপরতাকে পুতপবিত্র ও নিষ্কলুস কর্ম হিসেবে বিবেচনা করেন।
হাসানুল বান্নার আকস্মিক বদলীর আশংকায় শংকিত হয়ে, ইখওয়ানের সাংগঠনিক তৎপরতায় ব্যাঘাত সৃষ্টি রোধে কর্মীরা তাকে সহকারী নিয়োগের প্রস্তাব দেন। এ প্রস্তাব যথেষ্ট যৌক্তিক ছিল। তাই তিনি গভীর ও ব্যাপক চিন্তার পর শাইখ আলী আল জাদাওয়ীকে নিজের সহকারী নিয়োগের প্রস্তাব করেন। আলী আল জাদাওয়ী এক কথায় যেমন ভালো মানুষ ছিলেন তেমনি ছিলেন দ্বীনি দিক থেকেও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। এছাড়াও জ্ঞান গড়িমায়ও মোটেও পিছে ছিলেন না। তিনি ঐ সব নিষ্ঠাবান ব্যক্তির অন্তর্ভুক্ত ছিলেন যারা এ আন্দোলনের আহ্বানে সাড়া দেয়ায় অগ্রবর্তী। এ সকল দিক বিবেচনায় ইখওয়ানের মধ্যে প্রিয়তম ব্যক্তি ছিলেন। সুতরাং, এক সাধারণ সভায়, ওস্তাদ হাসানুল বান্না তার সহকারী হিসেবে আলী আল জাদাওয়ীর নাম উত্থাপন করেন। ইখওয়ানের উপস্থিত সব সদস্য আনন্দ ও খুশিতে এ প্রস্তাব অনুমোদন করেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আনন্দের আতিশয্যে এ প্রস্তাব ও করেন যে আলী আল জাদাওয়ী নিজের ব্যবসা বাণিজ্য ছেড়ে দিয়ে ইখওয়ানের মসজিদের ইমামের দায়িত্বও পালন করবেন। এবং আন্দোলনের তহবিল থেকে তার জন্য মাসোহারার ব্যবস্থা করতে হবে- যাতে তিনি স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে সব ধরনের দায়িত্ব পালন করে যেতে পারেন। এ সময় শাইখ আলী আল জাদাওয়ী ফার্নিচারের ব্যবসা করতেন। উপস্থিত সবাই এক বাক্যে এ প্রস্তাব সমর্থন করেন। আলী আল জাদাওয়ীর জন্য নাম মাত্র মাসোহারা নির্ধারণ করা সত্ত্বেও তিনি তাতে সম্মত হয়ে যান।
অধ্যায় ০৭ : ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে
☼→
বান্না-জীবনী
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
রিসেন্ট ব্লগ পোষ্টস
বিষয়শ্রেণী
রাইটার
প্রিয়-ক্লিক
কিছু বই
- অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা
- অর্থনীতিতে রাসূল (সা) এর দশ দফা
- আদর্শ মানব মুহাম্মদ (সা)
- আসহাবে রাসূলের জীবনকথা
- ইসলাম ও জিহাদ
- ইসলাম পরিচিতি
- ইসলামী আন্দোলন : সাফল্যের শর্তাবলী
- ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক
- ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি
- ইসলামী দাওয়াত ও কর্মনীতি
- ইসলামী নেতৃত্বের গুণাবলী
- ইসলামী বিপ্লবের পথ
- ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন
- ইসলামী সমাজে মজুরের অধিকার
- একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণঃ তার থেকে বাঁচার উপায়
- চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান
- দায়ী’ ইলাল্লাহ - দা’ওয়াত ইলাল্লাহ
- নামাজ কেন আজ ব্যর্থ হচ্ছে
- নামায-রোজার হাকীকত
- মোরা বড় হতে চাই
- যাকাতের হাকীকত
- রাসূলুল্লাহর বিপ্লবী জীবন
- শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী ও তাঁর চিন্তাধারা
- সত্যের সাক্ষ্য
- হেদায়াত
0 comments: