অধ্যায় ১২ : নতুন উপলব্ধি

রাতের তৃতীয় প্রহর। হাসানুল বান্না সারা রাত অনিদ্রায় কাটান। অবশেষে ফজরের আজানের এক দেড় ঘণ্টা পূর্বে অন্তরের প্রশান্তির সন্ধানে মসজিদের দিকে রওনা হয়ে যান। আন্দোলন থেকে দূরে সরে যাওয়া এক ব্যক্তি আব্দুল্লাহর বাসা মসজিদের পথেই পড়ে। সেই বাড়ির পাশ দিয়ে যাবার সময় তিনি দেখতে পান যে, বাড়ির সর্বত্রই আলো জ্বলছে, জানালা গুলোও খোলা এবং বাড়ির ভেতর থেকে তর্ক বিতর্কের উচ্চ আওয়াজ আসছে। রাতের নিরবতার কারণে বাইরের সব কথাবার্তাই পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে। হাসানুল বান্না ল্য করে দেখেন, শাইখ ইমাদউদ্দিন সেখানে এসেছেন এবং ইখওয়ান থেকে বহিষ্কৃত সদস্যরা তার চার পাশে সমবেত হয়েছেন। শাইখ সাহেব তাদেরকে ধোকা প্রতারণা, দ্বন্দ্ব, মতদ্বৈততার রহস্য ও নিগূঢ়তত্ত্ব বিষয়ে জ্ঞান দান করছেন। এ দৃশ্য দেখে হাসানুল বান্না দ্রুত হাটা শুরু করেন।
 
সকাল বেলা তিনি শাইখ ইমাদউদ্দিনকে ডেকে আনেন। কথায় কথায় তিনি শাইখকে জিজ্ঞেস করেন যে, গত রাতে তিনি কোথায় ছিলেন? উত্তরে তিনি একটি দীর্ঘ কাহিনী শোনান-যার সার সংপে হলো, রাতে তিনি নিজের বাসায়ই ছিলেন। এর পর হাসানুল বান্না কথার প্রসঙ্গ পালটে, চলমান দ্বন্দ্ব সংঘাতের দিকে নিয়ে যান। তিনি ইঙ্গিত প্রদান করেন যে, এ দ্বন্দ্ব সৃষ্টির েেত্র তার যথেষ্ট অবদান (!) আছে বলে লোকজন মনে করেন। এ কথা শোনা মাত্রই তিনি নিজের নির্দোষিতা প্রমাণের পে সাফাই গাইতে শুরু করেন। এছাড়াও তিনি এ অভিযোগ মেনে নিতে অস্বীকার করেন। নিজের নির্দোষিতার পে নানা প্রকারের স্যা প্রমাণের উল্লেখ করতে শুরু করেন। এ ব্যক্তি এ ধরনের মিথ্যাচারের ব্যাপারে কতটুকু যোগ্য ও দ তা দেখে হাসানুল বান্না স্তম্ভিত হয়ে যান। এমনকি নিজের পবিত্রতা প্রমাণের পে স্ত্রী তালাকের শপথ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যান। কিন্তু হাসানুল বান্না তাকে এ ধরনের অপকর্ম করতে বাধা প্রদান করেন। হাসানুল বান্না দ্রুত তার মুখ চেপে ধরেন।

হাসানুল বান্না চিৎকার করে ওঠেন , খবরদার! আল্লাহকে ভয় করো! এ ধরনের শপথ থেকে বিরত থাকো! এবং বলো,গত রাতে ফজরের আজানের আগে তুমি কার বাড়িতে বসা ছিলে? একথা শোনা মাত্রই তার বুদ্ধি লোপ পায় এবং চু স্থির হয়ে যায়। তিনি চেষ্টা করেন কোনো জওয়াব তৈরি করে উপস্থাপন করা যায় কিনা। কিন্তু তার জিহ্বা আটকে যায়। হাসানুল বান্না তাকে আর অধিক সুযোগ না দিয়ে প্রকৃত সত্য তার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। তার জবাব যে গ্রহণযোগ্য নয় সে প্রমাণও হাসানুল বান্না উপস্থাপন করেন। তাকে তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দেন যে, কারো কাছ থেকে শোনা নয়, তিনি তার এসব চালবাজি নিজের চোখে দেখেছেন। অতএব কোনো প্রকার উপায়ান্তর না থাকায় তাকে দোষ স্বীকার করতে হয়। অবশেষে বলতে বাধ্য হন, আমি লজ্জিত, আপনি আমার প্রতি দয়া, অনুগ্রহ ও উদার আচরণ করুন।

হাসানুল বান্না বলেন, ভয়ের কারণ নেই, নিশ্চিন্ত থাকুন। আপনাকে আঘাত দেয়ার মত কোনো কাজের কথা আমার পে চিন্তা করাও অসম্ভব। কেন না, গতকাল পর্যন্ত আমি আপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলাম, আপনাকে সবার সামনে তুলে ধরতাম এবং আপনার পিছনে নামাজ পড়তাম, লোকজনকে আপনার দরসে অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহিত করতাম। আর আজকে আমি আপনাকে কি তিরস্কার করতে পারি কিংবা চৌরাস্তায় অপদস্থ করতে পারি? আপনার যে অপরাধ আমার কাছে প্রকাশিত হয়েছে তা কখনো জনসমে প্রকাশ করবো না। কিন্তু আমি এটাও মেনে নিতে পারছি না যে, আপনার মত লোক আমার সাথে দাওয়াত ও আন্দোলনের কাজে সংশ্লিষ্ট থাকবে। আপনার সামনে দুটি পথ খোলা আছে। আপনি এ দুটির যেকোনো একটি বেছে নিতে পারেন। আপনি ইসমাঈলিয়াতেই থাকবেন এবং আমি আপনাকে একটি কাজ জুটিয়ে দিবো। তবে তা হবে ইখওয়ানের গণ্ডির বাইরে। এ অবস্থায় আপনি বর্তমান চাকরি থেকে অব্যাহতির জন্য কোনো যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য কারণ উল্লেখ্য করে পদত্যাগ পত্র দাখিল করবেন। দ্বিতীয় পথ হলো, আপনি নিজের শহরে চলে যাবেন, আমি আপনাকে সেখানে পৌঁছে দিয়ে আসবো।

হাসানুল বান্নার বক্তব্যের প্রেক্ষিতে শাইখ বলেন, আমি আপনার দ্বিতীয় প্রস্তাবটি মেনে নিচ্ছি। তবে শর্ত হচ্ছে, আমার কিছু ঋণ আছে, আপনি তা পরিশোধ করে দিবেন। হাসানুল বান্না তার শর্ত মেনে নিয়ে বলেন, ঠিক আছে। তিনি শাইখের ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করে দেন এবং শাইখ যথাবিহিত পদত্যাগ পত্র পেশ করেন। এতে মাদ্রাসা ও মসজিদের সাথে তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু তিনি তার নিজের এলাকায় ফিরে যাবার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন। একদিন হঠাৎ শোনা গেলো, তার নেতৃত্বে একটি নতুন স্কুল চালু করা হয়েছে। যে পাঁচ ব্যক্তির সাথে তিনি গাটছড়া বেঁধেছিলেন তাদের সমন্বয়ে একটি পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়েছে।

কিছুদিন অতিবাহিত হবার পর, স্থানীয় আদালতের একজন কর্মচারী হাসানুল বান্নার নিকট আদালতের একটি সমন নিয়ে উপস্থিত হন।

 সমনের বিষয়বস্তু হলো, শাইখ ইমাদ উদ্দিন যতদিন ইখওয়ানের প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন তিনি তত দিনের পাওনা দাবি করেছেন। যা নেহায়েতই একটি মামুলী পরিমান। কিন্তু ঘটনা হলো, এই যৎসামান্য পরিমাণ অর্থ আদায়ের জন্য তার মধ্যে আদালতের শরণাপন্ন হবার খায়েশ জেগেছে। হাসানুল বান্না নিজেই আদালতে উপস্থিত হয়ে যান। শাইখ নিজের দাবি উত্থাপন করেন। হাসানুল বান্না তার দাবি তাৎণিকভাবে স্বীকার করে নিয়ে বিচারকের সামনে ঐ সব কাগজপত্র তোলে ধরেন যাতে সই করে শাইখ ইমাদ প্রচুর পরিমাণ অর্থ গ্রহণ করেছেন।

বিচারক কাগজ পত্র উল্টে পাল্টে দেখেন এবং গভীর মনোযোগ সহকারে তা পর্যালোচনা করে সেগুলোর আইনগত ভিত্তি স্বীকার করে নেন। বিচারক শাইখের দাবি খারিজ করে দিয়ে তাকে মামলার ব্যয়ভার বহনের নির্দেশ প্রদান করেন। যে স্কুলটির বিষয়ে ধুমধামের সাথে প্রচার করা হয়েছিল তাও আলোর মুখ দেখতে পারেনি। বরং খোলার আগেই তা বন্ধ হয়ে যায়। শাইখ সাহেবকেও তল্পিতল্পাসহ ইসমাঈলিয়া ছেড়ে চলে যেতে হয়।

সাতাশ রমজানের রাত। দারুল ইখওয়ানের মসজিদে আনন্দ উল্লাস। মসজিদের মাঝখানে কিছু লোক খুবই আগ্রহ ও ভালোবাসা নিয়ে একে অপরের গা ঘেঁষে বসেছেন। বসা লোকদের পেছনে কিছু লোক গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। এদের সবাই খুব আগ্রহের সাথে শাইখ জমলুতের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছেন। তার সামনে নতুন আভায় সজ্জিত হাসানুল বান্না অত্যন্ত আদব ও শিষ্টাচারের সাথে মাথা নিচু করে বসে আছেন।

শাইখ জমলুত তার পাশে বসা আলহাজ্ব হোসাইন আসসাউলীর সাথে খুবই নিচু স্বরে কথা বলছেন। কিছুণ পর তিনি সামনের দিকে পাশ ফিরে হাসানুল বান্নার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলেন, হোসাইন আসসাউলীর কন্যা লতিফাকে “মহরে মিছালের” বিনিময়ে আহমদ আব্দুর রহমানের পুত্র হাসানুল বান্নার সাথে শাদী দেয়ার প্রস্তাব করা হলো, এতে কি তুমি রাজী আছো? হাসানুল বান্না খুবই নিচু স্বরে জবাব দেন, হ্যাঁ, কবুল। তিন বার ইযাব ও কবুলের পর শাইখ জমলুত দুই হাত তুলে মোনাজাত করেন। তার সাথে মসজিদে সমবেত সবাই দোয়ায় শরীক হন। মোনাজাত শেষ হবার পর মসজিদে ‘মোবারকবাদ’ ‘মোবারকবাদ’ ধ্বনি ওঠে।

ইসমাঈলিয়ার ঈমানদার লোকেরা হাসানুল বান্নার খুবই ভক্ত ছিলেন। তাদের মধ্যে এক পুণ্যবান ব্যক্তি ছিলেন আলহাজ্ব হোসাইন আসসাউলী। তিনি ইসমাঈলিয়ার শরীফ ব্যক্তিবর্গের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি হাসানুল বান্নার দাওয়াত ও চারিত্রিক মাধুর্যে আকৃষ্ট হয়ে তার সাথে খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। বহু কাজেই তিনি হাসানুল বান্নার পৃষ্ঠপোষকতা করেন। হোসাইন আসসাউলীর সন্তানেরা সবাই হাসানুল বান্নার আদর্শের অনুসারী। সুতরাং হোসাইন আসসাউলী শুধুমাত্র আত্মার আত্মীয়তাকেই যথেষ্ট মনে না করে স্নেহ ভালোবাসার সম্পর্ককে আরো গভীর করার আকাক্সায় তার কাছে নিজের কন্যাকে বিয়ে দেয়ার প্রস্তাব পাঠান। সুতরাং এ উপলে হাসানুল বান্নার পিতামাতা কায়রো থেকে ইসমাঈলিয়ায় আসেন। পহেলা রমজান বিয়ের কথা পাকাপোক্ত করা হয় এবং সাদামাটা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সাতাশ রমজান রাতে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হয়।

১৯৩২ সালের গ্রীষ্মের ছুটিতে হাসানুল বান্না কায়রোতে বাবা মা’র কাছে চলে যান। সেখানে পৌঁছে তার মনে নতুন উপলব্ধি জাগে। তিনি অনুভব করেন, যতদিন পর্যন্ত দেশের রাজধানী কায়রোতে ইখওয়ানের কাজ দৃঢ় ভিত্তির উপর সুপ্রতিষ্ঠিত না হবে ততদিন পর্যন্ত গোটা মিসরে সর্বসাধারণের কাছে ইখওয়ানের আন্দোলন গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। ইসমাঈলিয়ায় পাঁচ বছরের চেষ্টা সাধনার ফলে দাওয়াতি ও সাংগঠনিক দৃঢ়তা অর্জিত হয়েছে। এ কারণে অবস্থা ও পরিবেশের দাবি এটাই যে, এ মুহূর্তে রাজধানীকেই ইখওয়ানের দাওয়াতি কাজের কেন্দ্র নির্বাচন করা উচিত। কায়রোতে ইখওয়ানের দাওয়াতি কাজ শুরু হলেও তখনো পর্যন্ত তা কেন্দ্রীয় শহরের দাবি অনুযায়ী বিস্তার লাভ করতে সম হয়নি। সুতরাং হাসানুল বান্না বন্ধুদের সাথে পরামর্শ করে ইসমাঈলিয়া থেকে কায়রো বদলির জন্য শিক্ষা অধিদপ্তরে আবেদন পেশ করেন।

১৯৩২সালের অক্টোবরে তাকে কায়রোর একটি স্কুলে বদলি করা হয়।

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম