বিপুল সংখ্যক মানুষের সমাবেশ। তিনি আত্মিক পরিশুদ্ধির প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্বের উপর বক্তব্য রাখেন। বক্তব্যে তিনি সব মানুষের কল্যাণ কামনা ও মতবিরোধকালে বিবদমান গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে মীমাংসা করা সংক্রান্ত বিষয়ে হৃদয়গ্রাহী ও বাস্তবসম্মত বক্তব্য দান করেন। শ্রোতারা গভীর মনোযোগ সহকারে আত্মিক পরিশুদ্ধির এ সম্পদ আহরণ করেন। তিনি জমায়েত স্থলের এক কোনায় বসে গভীর চিন্তামগ্ন হয়ে নিজের বিবেক প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে থাকেন।
নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেন, হাসান! তুমি মানুষকে তো ভালো কাজের নির্দেশ দাও এবং নিজকে ভুলে যাও। তোমার এসব কর্মকাণ্ড কি বৈপরীত্যপূর্ণ নয়? আল্লাহর নিকট সেই ব্যক্তি অধিক প্রিয় যে কষ্ট ও আনন্দ উভয় অবস্থায় আল্লাহর পছন্দনীয় পথে অগ্রসর হয়। অপর দিকে ঐ ব্যক্তিই আল্লাহর ক্রোধের পাত্র যে হটকারী ও ঝগড়াটে। রাসূল (সা.) বলেছেন, আমি কি তোমাদের সেই কাজের কথা বলবো না, যা নামাজ, রোজা, সাদকা বা দান খয়রাতের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি মর্যাদাবান? সাহাবায়ে কেরাম অনুরোধ করলেন, হ্যাঁ, আপনি বলুন। জবাবে রাসূল (সা.) বলেন, বিবদমান লোকদের মধ্যে সমঝোতা করানো। একের বিরুদ্ধে অন্যকে উস্কে দেয়া জঘন্য অপরাধ-যা মাথা মুণ্ডন করে দেয়ার মতো। আমি একথা বলছি না যে, এটি মাথার চুলকে মুণ্ডন করে দেয় বরং এটা দ্বীনকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়।
হে হাসান! অন্তরের পবিত্রতা ও আত্মিক পরিশুদ্ধি তোমার যতটুকু প্রয়োজন , অন্যের ততটুকু প্রয়োজন নেই। তুমি অন্যকে উপদেশ দিয়ে নিজের জন্য অপমান কুড়িয়ে নিচ্ছ। নিজের প্রবৃত্তির চাহিদাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে ক্রোধ ও প্রতিহিংসাকে নিশ্চিহ্ন করে দাও। অতএব আপস রফার কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য তুমি আগে নিজের উপর অনুশীলন শুরু করো। বাড়াবাড়ির শুরু যদিও তোমার প থেকে হয়নি তার পরও পরীা করে দেখা খুব জরুরি।
এর পর হাসানুল বান্না কলম হাতে নিয়ে বিরোধী পরে নেতার কাছে চিঠি লিখতে শুরু করেন। তিনি লেখেন , অতীতে আপনারদের প থেকে যা ঘটেছে সার্বিক বিবেচনায় আমি বিষয়টি ভুলে যেতে প্রস্তুত। আপনারা চাইলে আপনাদের ইখওয়ানের কাতারে শামিল করা যেতে পারে। আপনারা যদি সততার ভিত্তিতে সমস্যার সমাধান করতে আগ্রহী হয়ে থাকেন তাহলে আমি তাও মেনে নিতে তৈরি আছি। আপনারা যদি তৃতীয় পরে মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে আগ্রহী হন তাহলে আমি তাও মানতে রাজী। এখনি আমি একথা জানিয়ে দিচ্ছি যে, তৃতীয়প যে রায় ঘোষণা করবেন আমি বিনা বাক্য ব্যয়ে তা মেনে নিতে প্রস্তুত আছি।
ইখওয়ান কর্মীরা যখন জানতে পারেন যে, হাসানুল বান্না নিজেই এই চিঠি নিয়ে তাদের কাছে যাচ্ছেন তখন তারা ক্ষোভে ফেটে পড়েন।
তারা এটাকে তাদের নেতার জন্য মর্যাদা হানিকর মনে করেন। কিন্তু হাসানুল বান্না নিজের হাতে এই চিঠি পৌছানোর কাজে ভিন্ন রকমের আনন্দ অনুভব করেন। এ চিঠির আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা পূর্ণ বাক্যসমূহ তাদের অন্তরে কোনো প্রভাব প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়। এছাড়া বিচ্ছিন্ন গ্রুপের নেতা অপপ্রচার মূলক কাগজপত্র ছাপানো থেকেও বিরত থাকেননি। কারণ তাদের মধ্যে এক ব্যক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ের আত্মরম্ভিতায় পৌঁছে যান এবং অন্য সঙ্গীদের বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি নিজের নামে প্রচার পত্রগুলো ছাপিয়ে বিলি করেন। এই মিথ্যা প্রচারপত্রগুলো জনগণের মধ্যে প্রচারিত হবার পর ইখওয়ান ‘কালেমাতুল হক’ নামে প্রতিবাদ লিপি ছেপে বিতরণ করে। এ প্রতিবাদ লিপি সাধারণ মানুষ ইখওয়ানের প্রতি ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট করে। বিরোধীদের এ সমস্ত প্রচার প্রচারণাও সত্যের দাওয়াত ও আন্দোলন ব্যাপক প্রচার ও প্রসার লাভে সহায়তা করে। এর ফলে বিপুল সংখ্যক মানুষ ইখওয়ানের কাতারে শামিল হয়ে যান।
ইখওয়ানের উপর সুকৌশলে ও সুসংগঠিতভাবে যে অভিযোগ ও মিথ্যাচার করা হয়েছিল- বিষয়টি আদালতে নেয়া যায় কিনা এই মর্মে আলোচনা পর্যালোচনার জন্য হাসানুল বান্না ইখওয়ানের কার্যনির্বাহী পরিষদের বৈঠক আহ্বান করেন। এশার নামাজের পর মসজিদে বৈঠকের সময় নির্ধারণ করা হয়। নামাজ শেষ হবার পর মসজিদে বসে থাকা এক ব্যক্তি উচ্চ স্বরে কোরআন তেলাওয়াত করতে থাকেন।
‘আর এভাবে আমি সব সময় মনুষ্য জাতীয় শয়তান ও জিন জাতীয় শয়তানদের প্রত্যেকে নবীর দুশমনে পরিণত করেছি। তারা ধোঁকা ও প্রতারণার ছলে পরস্পরকে চমকপ্রদ কথা বলতো। তোমার রব চাইলে তারা এমনটি কখনো করতো না। কাজেই তাদেরকে তাদের অবস্থার উপর ছেড়ে দাও, তারা মিথ্যা রচনা করতে থাকুক (এসব কিছু আমি তাদের এজন্য করতে দিচ্ছি যে) যারা আখেরাত বিশ্বাস করে না তাদের অন্তর এ (সুদৃশ্য) প্রতারণার প্রতি ঝুঁকে পড়ুক, তারা এর প্রতি তুষ্ট থাকুক এবং যেসব দুষ্কর্ম তারা করতে চায় তা করতে থাকুক।
এমতাবস্থায় আমি কি আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো মীমাংসাকারীর সন্ধান করব? অথচ তিনি পূর্ণ বিস্তারিত বিবরণসহ কিতাব নাজিল করেছেন।
আর যাদের আমি (তোমার আগে) কিতাব দিয়েছিলাম তারা জানে এ কিতাবটি তোমার রবেরই প থেকে সত্য সহকারে নাজিল হয়েছে। কাজেই তুমি সন্দেহ পোষণকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।’ (আল-আন’আম ১১২-১১৪ )
লোকটির উচ্চস্বরে এই কোরআন তেলাওয়াত বৈঠকে জমায়েত হওয়া ব্যক্তিরা তন্ময় হয়ে শুনতে থাকেন। অপরদিকে হাসানুল বান্নাও নীরব নিস্তব্ধ হয়ে আয়াতের উপর চিন্তা করতে থাকেন। কয়েকটি আয়াত তেলাওয়াতের পর লোকটি নীরবতা অবলম্বন করেন। এর পর ইখওয়ান কর্মীরা পরস্পর নিজেদের জিজ্ঞেস করেন, আমরা এখানে কেন সমবেত হয়েছি? হাসানুল বান্না জবাবে কুরআনের আয়াত উদ্ধৃত করে বলেন, ‘আমি কি আল্লাহ ছাড়া অন্যকোনো সিদ্ধান্ত দাতার সন্ধান করবো?’ এই আয়াত আমাদের সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে। এখন আমি বৈঠকের এজেন্ডার মধ্য থেকে আদালতে যাবার বিষয় সংক্রান্ত প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। আল্লাহর এই নির্দেশই আমাদের জন্য যথেষ্ট।
ইখওয়ানের নেতা হবার খায়েশ পোষণকারী শাইখ ইমাদ উদ্দিন আল আজহারী তখনো ইখওয়ানের শিা প্রতিষ্ঠানে শিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং দূর থেকে নিজের ধূর্ত চালের মাধ্যমে এই উস্কানিমূলক তৎপরতা অব্যাহত রাখার পৃষ্ঠপোষকতা করে যাচ্ছিলেন। তিনি এমনি ধূর্ত ও সতর্ক ছিলেন, তার বিরুদ্ধে আনিত যেকোনো অভিযোগ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে নিতে পারতেন। উস্তাদ হাসানুল বান্নাও তার বিরুদ্ধে শুধুমাত্র আন্দাজ অনুমান নির্ভর কোনো প্রদপে গ্রহণে সম্মত ছিলেন না। এ সুযোগে শাইখ ইমাদউদ্দিন ষড়যন্ত্রের গোড়ায় পানি ঢালতে থাকেন। নিজের উপর যাতে কোনো ধরনের দায় দায়িত্ব না চাপে -এ বিষয়টি সতর্কতার সাথে সামলে নিয়ে তিনি তার এ ‘মিশন’ চালিয়ে যেতে থাকেন।
অধ্যায় ১১ : খোদায়ী ফায়সালা
☼→
বান্না-জীবনী
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
রিসেন্ট ব্লগ পোষ্টস
বিষয়শ্রেণী
রাইটার
প্রিয়-ক্লিক
কিছু বই
- অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা
- অর্থনীতিতে রাসূল (সা) এর দশ দফা
- আদর্শ মানব মুহাম্মদ (সা)
- আসহাবে রাসূলের জীবনকথা
- ইসলাম ও জিহাদ
- ইসলাম পরিচিতি
- ইসলামী আন্দোলন : সাফল্যের শর্তাবলী
- ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক
- ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি
- ইসলামী দাওয়াত ও কর্মনীতি
- ইসলামী নেতৃত্বের গুণাবলী
- ইসলামী বিপ্লবের পথ
- ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন
- ইসলামী সমাজে মজুরের অধিকার
- একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণঃ তার থেকে বাঁচার উপায়
- চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান
- দায়ী’ ইলাল্লাহ - দা’ওয়াত ইলাল্লাহ
- নামাজ কেন আজ ব্যর্থ হচ্ছে
- নামায-রোজার হাকীকত
- মোরা বড় হতে চাই
- যাকাতের হাকীকত
- রাসূলুল্লাহর বিপ্লবী জীবন
- শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী ও তাঁর চিন্তাধারা
- সত্যের সাক্ষ্য
- হেদায়াত
0 comments: