অধ্যায় ১০ : শাইখ জমলুতের মহানুভবতা

ঐ ব্যক্তিদের মিথ্যাচারের পর শাইখ জমলুত হাসানুল বান্নার সাথে সাক্ষাতের জন্য স্কুলে যান। তার চেহারার রং লাল বর্ণ ধারণ করে চলেছে। রাগ ও ক্রোধের চিহ্ন তার মুখমণ্ডলে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। স্কুলে গিয়ে অধ্যক্ষের অনুমতি নিয়ে হাসানুল বান্নাসহ বেরিয়ে আসেন।

পায়চারী করতে করতে তারা শহরের বাইরে পৌঁছে যান। তিনি ষড়যন্ত্রকারীদের কাছ থেকে যা কিছু শুনেছেন এরই মাঝে তা হাসানুল বান্নাকে অবহিত করেন। তিনি ধমকের স্বরে হাসানুল বান্নাকে বলেন, ‘মিঞা সাহেব! এুনি দ্রুত কায়রো চলে যাও। এসব ব্যক্তি যা কিছু বলছে তা যদি সত্যি হয় তাহলে দ্রুত নিজের ব্যবস্থা করে নাও। চেষ্টা করো তোমার গোপন তৎপরতার কোন দিক ... সত্যি যদি তোমার গোপন তৎপরতা থেকে থাকে ...তাহলে তা কোন অবস্থাতেই প্রকাশ পাবে না। যদি গোপন কোন রহস্য ফাঁসও হয়ে যায় এবং কোন ব্যাপারে যদি জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হও তাহলে পরিষ্কার বলে দিবে যে এ দলের সাথে তোমার কোন সম্পর্ক নেই, এ দলের প্রধান শাইখ জমলুত। মিঞা তুমি এই মুহূর্তে একজন যুবক মাত্র। তোমার একটা ভবিষ্যৎ আছে। তুমি সরকারি কর্মচারী এবং প্রশাসন তোমাকে ঝামেলায় ফেলতে পারে। তুমি আমাদের শহরে একজন অতিথি। তুমি এ দাওয়াতী কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করেছো। সকল দিক বিবেচনায় তুমি আমাদের কাছ থেকে কৃতজ্ঞতা ও সহানুভূতি পাওয়ার অধিকারী।

হাসানুল বান্না এই ঈমানদার ব্যক্তির সাহসিকতা ও পরিচ্ছন্ন বক্তব্যে প্রভাবিত হয়ে বলেন, জনাব! আপনি সম্পূর্ণ আস্থা রাখতে পারেন, আমরা যা কিছু করছি তা প্রকাশ্য দিবালোকেই করছি। এই গ্রুপটি যদি সত্যবাদী হতো তা হলে এরা বহু আগেই আমাদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরি করতো। এরা দেখেছে যে, আপনার মতো একজন পবিত্র অন্তরের মানুষ যখন অর্থ সম্পদ ও জায়গা দিয়ে আন্দোলনে সাহায্য করে আসছেন তাই আপনার সহানুভূতি ভালবাসা ইত্যাদি থেকে আমাদের বঞ্চিত করার জন্যই তারা একটি ভীতিপ্রদ চিত্র তুলে ধরেছে।


শাইখ জমলুত অত্যন্ত দরদ ভরা কণ্ঠে বলেন, হে আমার ভাই বান্না! আমি আমার চাচা শাইখ ঈদকে বহুবার বলতে শুনেছি যে, হে আমার আল্লাহ! যতক্ষণ পর্যন্ত আমি ইসলামের বিজয় দেখতে না পাই ততক্ষণ পর্যন্ত আমাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে নিও না। তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেছেন, আমার নিজেরও একই আশঙ্কা। আমি ইসলামের বিজয় নিজের চোখে দেখে যেতে চাই। কিন্তু আমি অনুভব করছি এ গন্তব্য এখনো বহুদূরে। কারণ মুসলমানদের কাছে তাদের রক্ত এখনো খুব প্রিয় ও মূল্যবান। যতদিন মুসলমানরা এ রক্তকে মূল্যবান মনে করতে থাকবে ততদিন তারা কোন কিছু অর্জন করতে পারবে না। সম্মান মর্যাদা ও স্বাধীনতা অর্জনের একমাত্র বিনিময় হতে পারে রক্তের ফোঁটা। কুরআন এ সত্যকেই তুলে ধরে। সিরাতে নববী (সা.) এবং সাহাবায়ে কেরামের জীবনচরিত এ সত্যেরই সাক্ষ্য দেয়। কথা এই নয় কি?’

হাসানুল বান্না তার বক্তব্যকে সমর্থন করে বলেন, জী হ্যাঁ! আপনি যা কিছু বলেছেন তা সত্য। আমি আপনাকে দৃঢ়তার সাথে একথা বলছি যে, সত্যিকার ঈমানই মানুষের রক্তকে সস্তা কিংবা মূল্যবান বানাতে পারে। কেননা ঈমানের পথে প্রবাহিত রক্তের প্রতিদান আল্লাহর নিকট অত্যন্ত মর্যাদাবান। আমি দেখতে পাচ্ছি ঈমানের স্ফুলিঙ্গ একটি খোদাপ্রেমিক গোষ্ঠীর অন্তরে প্রজ্বলিত হতে চলেছে। ইনশাআল্লাহ এই গোষ্ঠীর হাতেই মুক্তি ও কল্যাণের মহৎ কার্যাবলী সম্পাদিত হবে। এই নতুন ও তরুণ ইখওয়ানীদের আপনি কল্যাণের প্রতি আগ্রহী হিসেবে দেখতে পারেন।

শাইখ জমলুত বেদনাকাতর কণ্ঠে বলেন, ‘এ গোষ্ঠী একান্তই স্বল্প সংখ্যক।’ ‘ভবিষ্যতে এ সংখ্যাল্পতা সংখ্যাগরিষ্ঠতায় রূপান্তরিত হবে। বরকত এ সংখ্যাল্পতায় লুক্কায়িত রয়েছে। আল্লাহপাক ঘোষণা করেছেন, ‘বহুবার দেখা গেছে, একটি ুদ্র গোষ্ঠী আল্লাহর ইচ্ছায় অনেক বড় দলের ওপর বিজয়ী হয়েছে।’ ‘আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি, তিনি যেন তোমাকে এভাবেই সুসংবাদ দান করেন।’ শাইখ জমলুত আকাশের দিকে দুই হাত তুলে হাসানুল বান্নার জন্য দোয়া করেন।

এই চার পাঁচজন বিরোধিতাকারী ব্যক্তি দলের ক্ষতি করার আর কোন পথ খুঁজে না পেয়ে মিথ্যা প্রচারপত্র, পুস্তিকা, ভিত্তিহীন কিচ্ছাকাহিনী ছেপে বিলি করতে শুরু করে। কখনো অভিযোগ করতো যে, দল পরামর্শের পন্থা পরিহার করে চলছে। কখনো বলতো যে, মসজিদের হিসাবপত্র এখনো পর্যন্ত সাধারণ মানুষকে জানানো হয়নি। স্কুলের আসবাবপত্র টেন্ডার দেয়া ছাড়াই কেনা হয়েছে। জনগণের অধিকার রয়েছে দলের নেতাদের সমালোচনা করার।

এসব লোক মনগড়া যেসব প্রচার পত্র ছাপতে যাচ্ছে তার খবর হাসানুল বান্নার কাছে পৌঁছে যায়। তিনি এ প্রেক্ষিতে ঐ গোষ্ঠীর হর্তাকর্তার বাসায় চলে যান। ঐ ব্যক্তি খুব বুদ্ধিমান ছিলেন। প্রথম যুগে আন্দোলনে আসার ও বয়সের কারণে হাসানুল বান্না তাকে খুব সম্মান করতেন। হাসানুল বান্না তাকে জিজ্ঞেস করেন যে, এ ধরনের প্রচারপত্র তৈরি করা হচ্ছে এটাকি ঠিক? এর জবাব না দিয়ে ভদ্রলোক পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। হাসানুল বান্না ছাপা হতে যাচ্ছে এমন প্রচারপত্রের কিছু কিছু বাক্য তাকে দেখান। তিনি নিরূপায় হয়ে স্বীকার করেন যে, এ ধরনের প্রচারপত্র ছাপানোর জন্য ছাপখানায় দেয়া হয়েছে।

তার জবাব শুনে হাসানুল বান্না বলেন, কোন অসুবিধা নেই! আমি আপনার কাছে এখন এ জন্য আসিনি যে, আপনাকে কাকুতি মিনতি করে বলবো, আপনারা এ প্রচার পত্র ছাপানো বন্ধ করে দিন অথবা দলের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করা থেকে বিরত থাকুন। আপনার বিবেকের মালিক আপনি, যা ইচ্ছা তাই করুন। কিন্তু আমি আপনাকে এখনো একজন বুদ্ধিমান ও বিবেকবান লোক বলে মনে করি। প্রতিটি কাজের মূল্য ও মর্যাদা এর পরিণতি ও প্রতিদান দ্বারা সম্পৃক্ত হয়ে থাকে। প্রতিশোধ স্পৃহা কানাকড়ি পরিমাণ কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। এসব প্রচারপত্র ছাপিয়ে আপনারা কোন পরিণতির আশায় বসে আছেন?’

ষড়যন্ত্রকারী গ্রুপের পালের গোদা বলেন, আমরা জনমতকে সচেতন ও তাদের প্রকৃত সত্য সম্পর্কে অবহিত করতে চাই।’ যে বিষয়কে আপনি সত্য মনে করছেন এবং আমি যেটাকে সরাসরি মিথ্যা মনে করছি এ ধরনের বিষয়ে আমি আপনার সাথে কখনোই বিতর্কে যেতে চাই না। তবে আপনাকে একটি কথাই বলতে চাই যে, আপনি কি ধরে নিয়েছেন যে, আমরা এ মিথ্যাচারের জবাব দিতে অক্ষম। আপনাদের কাছে শুধু মিথ্যা অভিযোগ, আর এর বিপরীতে আমাদের কাছে রয়েছে প্রতিটি বিষয়ের লিখিত দলিল প্রমাণ ও আইনগত প্রয়োজনীয় দস্তাবেজ। আর আপনারা নিজেরাই অন্য লোকদের চেয়ে প্রকৃত সত্য সম্পর্কে সর্বাধিক অবগত। মসজিদের সব হিসাব আপনার হাতেই ছিল। স্কুলের সকল প্রকার কেনাকাটা আপনার হাত দিয়েই হয়েছে। অতএব আপনারা যখন লোকজনের দৃষ্টি আমাদের দিকে আকৃষ্ট করবেন তখন আমরাই লাভবান হবো, আপনারা কোনভাবেই লাভবান হতে পারবেন না। কেননা আমাদের কাছে প্রচার ও প্রকাশনার ঐসব উপকরণ রয়ে গেছে যা আপনাদের কাছে নেই। সাধারণ মানুষের সাথে আমাদের সম্পর্ক অধিকতর শক্তিশালী। আমরা এসব বিষয় জনসমক্ষে তুলে ধরতে সক্ষম। আমরা এসব বিষয় সভা ডেকে জনগণের কাছে পরিষ্কার করতে পারি এমনকি মসজিদের খুতবায়ও বর্ণনা করতে পারি। মসজিদ, কফিখানা ও বাজারেও আমরা এসব বিষয় প্রচার করতে পারি। সত্য প্রচারের জন্য আমাদের কাছে অসংখ্য বক্তা ও লেখক বর্তমান রয়েছে। আর সত্য সুস্পষ্ট দিবালোকের মত নিজে নিজেই প্রকাশিত হয়ে থাকে। এ বিষয়ে আমার কাছে একটিমাত্র ব্যাপার কষ্টকর ও বেদনাদায়ক, বিষয়টি হচ্ছে, গতকাল পর্যন্ত আপনাকে জনগণের সামনে এমনভাবে উপস্থাপন করেছি যেভাবে পুত্র তার পিতাকে মানুষের সামনে সম্মান ও মর্যাদার সাথে উপস্থাপন করে থাকে। আপনার সাথে যেসব যুবক রয়েছে তাদেরও ইসলামের জন্য আত্মোৎস্বর্গকারী যুবক হিসেবে মানুষের কাছে পরিচয় করিয়ে দিয়েছি। এ মুহূর্তে আপনারা যে অবস্থান গ্রহণ করেছেন তার প্রেক্ষিতে বাধ্য হয়েই আমাকে আন্দোলনের স্বার্থে বলতে হবে আপনারা আন্দোলনের ক্ষতি করার জন্য মিথ্যাচার করেছেন, অপপ্রচার চালিয়েছেন, আমানতের খিয়ানত করেছেন, গাদ্দারী ও অকৃতজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন। এহেন অবস্থার কথা কল্পনা করতেও আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠছে।

এসব কষ্ট ও বেদনা তখনই অধিক বৃদ্ধি পায় যখন ভাবি প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধমূলক এসব অকান্ত পরিশ্রম কোন শুভ ও কল্যাণকর ফল বয়ে আনবে না। এ দ্বন্দ্ব হিংসা বিদ্বেষ ও পারস্পরিক মানমর্যাদাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। কল্যাণকর দিক হলো আপনারা এসব দ্বন্দ্ব সংঘাত পরিহার করবেন। এর পরিণতি আপনাদের জন্য কেমন হবে তা আপনারা নিজেরাই ভালো উপলব্ধি করতে পারেন। যদি প্রতিশোধই আপনাদের কাম্য হয়ে থাকে তাহলে জেনে রাখুন এটা নিতান্তই অকল্যাণকর কাজ। যদি সদোপদেশ ও কল্যাণকামিতাই আপনাদের দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে থাকে তাহলে ইতোমধ্যে আপনারা তা করে ফেলেছেন, আর লোকজনও জেনে গেছে যে, আপনারা কি বলতে চান। আপনাদের দৌড়ঝাঁপ ও বিরোধিতা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে হয়ে থাকে তাহলে নিশ্চিত জেনে রাখুন আল্লাহ মানুষের অন্তরের খবর জানেন।

হাসানুল বান্নার এ ধরনের বক্তব্যে ঐ ব্যক্তি খুবই প্রভাবিত হয়ে পড়েন। তিনি হাসানুল বান্নাকে প্রতিশ্রুতি দেন যে, উল্লিখিত প্রচারপত্র ছাপা বন্ধ করে দিবেন এবং প্রচারপত্রের মূল কপি ছাপাখানা থেকে ফেরত আনার ব্যবস্থা করবেন।

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম