পরশুরামের লেখা একটি ভৌতিক গল্পের নাম 'মহেশের মহাযাত্রা'। পরশুরাম অতিপণ্ডিত এবং অতিরসিক একজন মানুষ। তাঁর রসবোধের নমুনা দিই-
রেস্টুরেন্টে এক ছেলে তার বন্ধুদের নিয়ে চা খেতে গিয়েছে। ছেলেটির বাবাও হঠাৎ করে সেখানে গেলেন। ছেলেকে রেস্টুরেন্টে আড্ডা দিতে দেখে রেগে অগি্নশর্মা হয়ে প্রচুর গালাগাল করে বের হয়ে এলেন। ছেলের বন্ধুরা বলল, তোর বাবা তোকে এত গালমন্দ করল, আর তুই কিছুই বললি না?
ছেলে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বাবার কথার কী করে জবাব দিই! একে তো তিনি বাবা, তারপর আবার বয়সেও বড়।
বাবা ছেলের চেয়ে বয়সে বড়-এই হলো পরশুরামের রসবোধ। তিনি হাসি-তামাশা, ব্যঙ্গ-রসিকতার গল্পের ভিড়ে
'মহেশের মহাযাত্রা' নামের অদ্ভুত এক ভূতের গল্পও লিখে ফেললেন। মহেশ নামের এক পাঁড় নাস্তিকের গল্প, যে মহেশ অঙ্ক দিয়ে প্রমাণ করেছে ঈশ্বর সমান শূন্য।
একদল নাস্তিকের ঈশ্বরকে শূন্য প্রমাণ করার চেষ্টা যেমন আছে, আবার কঠিন আস্তিকদের চেষ্টা আছে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করার। ঢাকা ইউনিভার্সিটি জার্নালে অঙ্কের একজন শিক্ষক ইনফিনিটি সিরিজ দিয়ে প্রমাণ করলেন ঈশ্বর আছেন। ভুবনখ্যাত অঙ্কবিদ ইউলার চার্চের সঙ্গে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিতর্কে জড়িয়ে পড়লেন। তিনি ব্ল্যাকবোর্ডে বিদঘুটে এক অঙ্ক লিখে বললেন, এই সমীকরণ প্রমাণ করে ঈশ্বর নেই। আপনারা কেউ কি এই সমীকরণ ভুল প্রমাণ করতে পারবেন? চার্চের পাদ্রিরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন। কারণ, অঙ্ক-বিষয়ে তাদের জ্ঞান নেই।
সম্প্রতি পত্রিকায় দেখলাম কঠিন তাত্তি্বক পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং বলেছেন, ঈশ্বর এবং আত্মা বলে কিছু নেই। স্বর্গ-নরক নেই। সবই মানুষের কল্পনা। মানব-মস্তিষ্ক হলো একটা কম্পিউটার। কারেন্ট চলে গেলে কম্পিউটার বন্ধ হয়ে যায়। মৃত্যু হলো মানব-মস্তিষ্ক নামক কম্পিউটারের কারেন্ট চলে যাওয়া।
স্টিফেন হকিং কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত। মস্তিষ্ক ছাড়া তাঁর শরীরে সব কলকবজাই অচল। তিনি নিজেই মনে করছেন তাঁর সময় ফুরিয়ে এসেছে। এ অবস্থায় মানুষ সাধারণত আস্তিকতার দিকে ঝুঁকে। তিনি পুরোপুরি অ্যাবাউট টার্ন করে বললেন, ঈশ্বর নেই। কোনো পবিত্র নির্দেশ ছাড়াই (Devine intervention) বিশ্বণ্ড তৈরি হতে পারে। শুরুতে এ ধরনের সরাসরি কথা তিনি বলতেন না। তাঁর কথাবার্তা ছিল সন্দেহবাদীদের মতো-ঈশ্বর থাকতেও পারেন, আবার না-ও থাকতে পারেন।
স্টিফেন হকিংয়ের এক উক্তিতে ঈশ্বর ধ্বংস হয়ে গেছে মনে করার কারণ নেই। আবার অনেক নোবেল পুরস্কার বিজয়ী পদার্থবিদের ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিষয়ে জোরালো বক্তব্যে ঈশ্বরের প্রতিষ্ঠা হয় না। ঈশ্বর অধরাই থেকে গেছেন।
আমি সামান্য বিপদে পড়েছি, স্টিফেন হকিংয়ের মন্তব্যে আমার কী বলার আছে, তা অনেকেই জানতে চাচ্ছেন। এসব জটিল বিষয়ে আমি নিতান্তই অভাজন। তার পরও বিচিত্র কারণে কিছু বলার লোভ সামলাতে পারছি না।
বিজ্ঞানীদের একটি শর্ত হকিং সাহেব পালন করেননি। তাঁরা পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে কিছু বলেন না। যখন পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারেন না তখন বলেন, তিনি অনুমান করছেন বা তাঁর ধারণা। হকিং সরাসরি বলে বসলেন, ঈশ্বর নেই। তিনি নিজেও কিন্তু পদার্থবিদ্যায় তাঁর থিওরি একাধিকবার প্রত্যাহার করেছেন।
হকিং সাহেবের ধারণা-অমরত্ব বলে কিছু নেই। তিনি সম্ভবত ভুলে গেছেন উঘঅ অণু অমর। আমাদের এবং এ জগতের সৃষ্ট সব প্রাণী ও বৃক্ষের প্রতি নির্দেশাবলি দেওয়া আছে উঘঅ-তে। আমরা কখন যৌবনে যাব, কখন বুড়ো হব-সব নিয়ন্ত্রণ করছে উঘঅ অণু। এই অণুই সদ্য প্রসব হওয়া গো-শাবককে জানিয়ে দিচ্ছে, একটি বিশেষ জায়গায় তোমার জন্য তরল খাবার রাখা আছে। মুখ দিয়ে সেখানে ধাক্কা দেওয়ামাত্র তোমার খাবার বের হয়ে আসবে। আমরা বাস্তবে কী দেখি? বাছুর মাতৃগর্ভ থেকে বের হয়ে ছুটে যাচ্ছে তার মায়ের ওলানের দিকে। তাকে কিছু বলে দিতে হচ্ছে না। তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে রহস্যময় উঘঅ.
এই রহস্যময় উঘঅ কি বলে দিচ্ছে না? 'হে মানব জাতি, তোমরা ঈশ্বরের অনুসন্ধান করো।' এ কারণেই কি মানুষ নিজের জন্য ঘর বানানোর আগে প্রার্থনার ঘর তৈরি করে?
হকিং বলছেন মানব-মস্তিষ্ক কম্পিউটারের মতো। সুইচ অফ করলেই কম্পিউটার বন্ধ। মৃত্যু মানব কম্পিউটারের সুইচ অফ।
সুইচ অফ করলেও কিন্তু কম্পিউটারের মেমোরি থেকে যায়। আবার পৃথিবীর সব কম্পিউটারের মেমোরি কিন্তু ইন্টারনেটের মাধ্যমে সংরক্ষণ সম্ভব।
মহা মহা শক্তিধর (আল্লাহ্, ঈশ্বর, গড) কারো পক্ষে একইভাবে প্রতিটি মানুষের মেমোরি সংরক্ষণও সম্ভব। তখনো কিন্তু আমরা অমর। সংরক্ষিত মেমোরি দিয়ে প্রাণ সৃষ্টিও সেই মহাশক্তিধরের কাছে কোনো বিষয়ই না।
মানুষ নিজেও মহা মহা শক্তিধর। সেই মানুষ কোনো কারণ ছাড়াই সৃষ্টি হয়ে গেল। বিশ্বণ্ডে কোনো বিশৃঙ্খলা নেই। তাকে কঠিন শৃঙ্খলার মধ্যে রাখা হয়েছে। তাকে পদার্থবিদ্যার প্রতিটি সূত্র মেনে চলতে হচ্ছে। এই সূত্রগুলো আপনা-আপনি হয়ে গেছে? এর পেছনে কি কোনো পবিত্র আদেশ (Devine order) নেই?
একদল বলছে, প্রাণের সৃষ্টি 'ঈযধড়ং' থেকে। অণুতে অণুতে ধাক্কাধাক্কিতে জটিল যৌগ তৈরি হলো। একসময় জটিল যৌগ আরো জটিল হলো। সে নিজের মতো আরো অণু তৈরি করল। সৃষ্টি হলো প্রাণ। অণুতে অণুতে ধাক্কাধাক্কিতে একদিকে তৈরি হলো ধীমান মানুষ, অন্যদিকে তৈরি হলো গোলাপ, যার সৌন্দর্য ধীমান মানুষ বুঝতে পারছে। ব্যাপারটা খুব বেশি কাকতালীয় নয় কি?
আমি ওল্ড ফুলস ক্লাবের আড্ডায় প্রায়ই ঈশ্বর-বিষয়ক একটি গল্প বলি। পাঠকদের গল্পটি জানাচ্ছি। ধরা যাক এক কঠিন নাস্তিক মঙ্গল গ্রহে গিয়েছেন। সেখানকার প্রাণহীন প্রস্তরসংকুল ভূমি দেখে তিনি বলতে পারেন-একে কেউ সৃষ্টি করেনি। অনাদিকাল থেকে এটা ছিল। তার এই বক্তব্যে কেউ তেমন বাধা দেবে না। কিন্তু তিনি যদি মঙ্গল গ্রহে হাঁটতে হাঁটতে একটা ডিজিটাল নাইকন ক্যামেরা পেয়ে যান, তাহলে তাঁকে বলতেই হবে এই ক্যামেরা আপনা-আপনি হয়নি। এর একজন সৃষ্টিকর্তা আছে। মনে করা যাক ক্যামেরা হাতে তিনি আরো কিছুদূর গেলেন, এমন সময় গর্ত থেকে একটা খরগোশ বের হয়ে এল। যে খরগোশের চোখ নাইকন ক্যামেরার চেয়েও হাজার গুণ জটিল। তখন কি তিনি স্বীকার করবেন যে এই খরগোশের একজন সৃষ্টিকর্তা আছে?
মনে হয় স্বীকার করবেন না। কারণ, নাস্তিক আস্তিক দুই দলই জেগে ঘুমিয়ে থাকার ভান করে বলে তাদের ঘুম ভাঙানো যায় না। বিপদে পড়ে সন্দেহবাদীরা। যতই দিন যায় ততই তাদের সন্দেহ বাড়তে থাকে। বাড়তেই থাকে।
পাদটিকা
রাতের অন্ধকারে এক অতিধার্মিক বাড়িঘর ছেড়ে পথে নেমেছেন। তাঁকে একজন জিজ্ঞেস করল, আপনি কোথায় যাচ্ছেন? তিনি বললেন, ঈশ্বরের সন্ধানে।
সেই লোক অবাক হয়ে বলল, সে কি! ঈশ্বর কি হারিয়ে গেছেন যে তার সন্ধানে বের হতে হচ্ছে?
রেস্টুরেন্টে এক ছেলে তার বন্ধুদের নিয়ে চা খেতে গিয়েছে। ছেলেটির বাবাও হঠাৎ করে সেখানে গেলেন। ছেলেকে রেস্টুরেন্টে আড্ডা দিতে দেখে রেগে অগি্নশর্মা হয়ে প্রচুর গালাগাল করে বের হয়ে এলেন। ছেলের বন্ধুরা বলল, তোর বাবা তোকে এত গালমন্দ করল, আর তুই কিছুই বললি না?
ছেলে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বাবার কথার কী করে জবাব দিই! একে তো তিনি বাবা, তারপর আবার বয়সেও বড়।
বাবা ছেলের চেয়ে বয়সে বড়-এই হলো পরশুরামের রসবোধ। তিনি হাসি-তামাশা, ব্যঙ্গ-রসিকতার গল্পের ভিড়ে
'মহেশের মহাযাত্রা' নামের অদ্ভুত এক ভূতের গল্পও লিখে ফেললেন। মহেশ নামের এক পাঁড় নাস্তিকের গল্প, যে মহেশ অঙ্ক দিয়ে প্রমাণ করেছে ঈশ্বর সমান শূন্য।
একদল নাস্তিকের ঈশ্বরকে শূন্য প্রমাণ করার চেষ্টা যেমন আছে, আবার কঠিন আস্তিকদের চেষ্টা আছে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করার। ঢাকা ইউনিভার্সিটি জার্নালে অঙ্কের একজন শিক্ষক ইনফিনিটি সিরিজ দিয়ে প্রমাণ করলেন ঈশ্বর আছেন। ভুবনখ্যাত অঙ্কবিদ ইউলার চার্চের সঙ্গে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিতর্কে জড়িয়ে পড়লেন। তিনি ব্ল্যাকবোর্ডে বিদঘুটে এক অঙ্ক লিখে বললেন, এই সমীকরণ প্রমাণ করে ঈশ্বর নেই। আপনারা কেউ কি এই সমীকরণ ভুল প্রমাণ করতে পারবেন? চার্চের পাদ্রিরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন। কারণ, অঙ্ক-বিষয়ে তাদের জ্ঞান নেই।
সম্প্রতি পত্রিকায় দেখলাম কঠিন তাত্তি্বক পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং বলেছেন, ঈশ্বর এবং আত্মা বলে কিছু নেই। স্বর্গ-নরক নেই। সবই মানুষের কল্পনা। মানব-মস্তিষ্ক হলো একটা কম্পিউটার। কারেন্ট চলে গেলে কম্পিউটার বন্ধ হয়ে যায়। মৃত্যু হলো মানব-মস্তিষ্ক নামক কম্পিউটারের কারেন্ট চলে যাওয়া।
স্টিফেন হকিং কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত। মস্তিষ্ক ছাড়া তাঁর শরীরে সব কলকবজাই অচল। তিনি নিজেই মনে করছেন তাঁর সময় ফুরিয়ে এসেছে। এ অবস্থায় মানুষ সাধারণত আস্তিকতার দিকে ঝুঁকে। তিনি পুরোপুরি অ্যাবাউট টার্ন করে বললেন, ঈশ্বর নেই। কোনো পবিত্র নির্দেশ ছাড়াই (Devine intervention) বিশ্বণ্ড তৈরি হতে পারে। শুরুতে এ ধরনের সরাসরি কথা তিনি বলতেন না। তাঁর কথাবার্তা ছিল সন্দেহবাদীদের মতো-ঈশ্বর থাকতেও পারেন, আবার না-ও থাকতে পারেন।
স্টিফেন হকিংয়ের এক উক্তিতে ঈশ্বর ধ্বংস হয়ে গেছে মনে করার কারণ নেই। আবার অনেক নোবেল পুরস্কার বিজয়ী পদার্থবিদের ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিষয়ে জোরালো বক্তব্যে ঈশ্বরের প্রতিষ্ঠা হয় না। ঈশ্বর অধরাই থেকে গেছেন।
আমি সামান্য বিপদে পড়েছি, স্টিফেন হকিংয়ের মন্তব্যে আমার কী বলার আছে, তা অনেকেই জানতে চাচ্ছেন। এসব জটিল বিষয়ে আমি নিতান্তই অভাজন। তার পরও বিচিত্র কারণে কিছু বলার লোভ সামলাতে পারছি না।
বিজ্ঞানীদের একটি শর্ত হকিং সাহেব পালন করেননি। তাঁরা পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে কিছু বলেন না। যখন পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারেন না তখন বলেন, তিনি অনুমান করছেন বা তাঁর ধারণা। হকিং সরাসরি বলে বসলেন, ঈশ্বর নেই। তিনি নিজেও কিন্তু পদার্থবিদ্যায় তাঁর থিওরি একাধিকবার প্রত্যাহার করেছেন।
হকিং সাহেবের ধারণা-অমরত্ব বলে কিছু নেই। তিনি সম্ভবত ভুলে গেছেন উঘঅ অণু অমর। আমাদের এবং এ জগতের সৃষ্ট সব প্রাণী ও বৃক্ষের প্রতি নির্দেশাবলি দেওয়া আছে উঘঅ-তে। আমরা কখন যৌবনে যাব, কখন বুড়ো হব-সব নিয়ন্ত্রণ করছে উঘঅ অণু। এই অণুই সদ্য প্রসব হওয়া গো-শাবককে জানিয়ে দিচ্ছে, একটি বিশেষ জায়গায় তোমার জন্য তরল খাবার রাখা আছে। মুখ দিয়ে সেখানে ধাক্কা দেওয়ামাত্র তোমার খাবার বের হয়ে আসবে। আমরা বাস্তবে কী দেখি? বাছুর মাতৃগর্ভ থেকে বের হয়ে ছুটে যাচ্ছে তার মায়ের ওলানের দিকে। তাকে কিছু বলে দিতে হচ্ছে না। তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে রহস্যময় উঘঅ.
এই রহস্যময় উঘঅ কি বলে দিচ্ছে না? 'হে মানব জাতি, তোমরা ঈশ্বরের অনুসন্ধান করো।' এ কারণেই কি মানুষ নিজের জন্য ঘর বানানোর আগে প্রার্থনার ঘর তৈরি করে?
হকিং বলছেন মানব-মস্তিষ্ক কম্পিউটারের মতো। সুইচ অফ করলেই কম্পিউটার বন্ধ। মৃত্যু মানব কম্পিউটারের সুইচ অফ।
সুইচ অফ করলেও কিন্তু কম্পিউটারের মেমোরি থেকে যায়। আবার পৃথিবীর সব কম্পিউটারের মেমোরি কিন্তু ইন্টারনেটের মাধ্যমে সংরক্ষণ সম্ভব।
মহা মহা শক্তিধর (আল্লাহ্, ঈশ্বর, গড) কারো পক্ষে একইভাবে প্রতিটি মানুষের মেমোরি সংরক্ষণও সম্ভব। তখনো কিন্তু আমরা অমর। সংরক্ষিত মেমোরি দিয়ে প্রাণ সৃষ্টিও সেই মহাশক্তিধরের কাছে কোনো বিষয়ই না।
মানুষ নিজেও মহা মহা শক্তিধর। সেই মানুষ কোনো কারণ ছাড়াই সৃষ্টি হয়ে গেল। বিশ্বণ্ডে কোনো বিশৃঙ্খলা নেই। তাকে কঠিন শৃঙ্খলার মধ্যে রাখা হয়েছে। তাকে পদার্থবিদ্যার প্রতিটি সূত্র মেনে চলতে হচ্ছে। এই সূত্রগুলো আপনা-আপনি হয়ে গেছে? এর পেছনে কি কোনো পবিত্র আদেশ (Devine order) নেই?
একদল বলছে, প্রাণের সৃষ্টি 'ঈযধড়ং' থেকে। অণুতে অণুতে ধাক্কাধাক্কিতে জটিল যৌগ তৈরি হলো। একসময় জটিল যৌগ আরো জটিল হলো। সে নিজের মতো আরো অণু তৈরি করল। সৃষ্টি হলো প্রাণ। অণুতে অণুতে ধাক্কাধাক্কিতে একদিকে তৈরি হলো ধীমান মানুষ, অন্যদিকে তৈরি হলো গোলাপ, যার সৌন্দর্য ধীমান মানুষ বুঝতে পারছে। ব্যাপারটা খুব বেশি কাকতালীয় নয় কি?
আমি ওল্ড ফুলস ক্লাবের আড্ডায় প্রায়ই ঈশ্বর-বিষয়ক একটি গল্প বলি। পাঠকদের গল্পটি জানাচ্ছি। ধরা যাক এক কঠিন নাস্তিক মঙ্গল গ্রহে গিয়েছেন। সেখানকার প্রাণহীন প্রস্তরসংকুল ভূমি দেখে তিনি বলতে পারেন-একে কেউ সৃষ্টি করেনি। অনাদিকাল থেকে এটা ছিল। তার এই বক্তব্যে কেউ তেমন বাধা দেবে না। কিন্তু তিনি যদি মঙ্গল গ্রহে হাঁটতে হাঁটতে একটা ডিজিটাল নাইকন ক্যামেরা পেয়ে যান, তাহলে তাঁকে বলতেই হবে এই ক্যামেরা আপনা-আপনি হয়নি। এর একজন সৃষ্টিকর্তা আছে। মনে করা যাক ক্যামেরা হাতে তিনি আরো কিছুদূর গেলেন, এমন সময় গর্ত থেকে একটা খরগোশ বের হয়ে এল। যে খরগোশের চোখ নাইকন ক্যামেরার চেয়েও হাজার গুণ জটিল। তখন কি তিনি স্বীকার করবেন যে এই খরগোশের একজন সৃষ্টিকর্তা আছে?
মনে হয় স্বীকার করবেন না। কারণ, নাস্তিক আস্তিক দুই দলই জেগে ঘুমিয়ে থাকার ভান করে বলে তাদের ঘুম ভাঙানো যায় না। বিপদে পড়ে সন্দেহবাদীরা। যতই দিন যায় ততই তাদের সন্দেহ বাড়তে থাকে। বাড়তেই থাকে।
পাদটিকা
রাতের অন্ধকারে এক অতিধার্মিক বাড়িঘর ছেড়ে পথে নেমেছেন। তাঁকে একজন জিজ্ঞেস করল, আপনি কোথায় যাচ্ছেন? তিনি বললেন, ঈশ্বরের সন্ধানে।
সেই লোক অবাক হয়ে বলল, সে কি! ঈশ্বর কি হারিয়ে গেছেন যে তার সন্ধানে বের হতে হচ্ছে?
হুমায়ুন আহমেদকে নাস্তিক প্রচারের বিরুদ্ধে এই লিঙ্কটি দিয়ে মানুষকে সঠিক মেসেজ দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিলো। এজন্য আরো কিছু সংযোজন করা হলো। যা বিষয়ের সাথে প্রাসঙ্গিক বা অপ্রাসঙ্গিক..
‘মৃত্যু নিয়ে প্রায়ই ভাবি’—হুমায়ূন আহমেদ
এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে আছেন নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। চিকি ৎসার জন্য নিউইয়র্কের পথে রওনা হওয়ার দুই দিন আগে তিনি মুখোমুখি হয়েছিলেনছুটির দিনের। সাক্ষা ৎকার নিয়েছেন আলীম আজিজ ও ইকবাল হোসাইন চৌধুরী
ধানমন্ডির ‘দখিন হাওয়া’র ফ্ল্যাটবাড়ির দরজাটা হাট করে খোলা। আমরা আসব বলে নয়, গৃহকর্তা ঘরের দরজা সব সময় উন্মুক্ত রাখতে চান বলে। বসার ঘরে বসি। দেয়ালে ঝোলানো পূর্ণেন্দু পত্রী আর এস এম সুলতানের চিত্রকর্মে চোখ বোলাতে বোলাতেই গৃহকর্তা হুমায়ূন আহমেদ চলে আসেন আমাদের মাঝে। গায়ে সবুজরঙা বাটিকের পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা।
আমরা ঘরের মাঝামাঝি একটা জায়গায় গিয়ে বসি। এক পাশে বুকশেলফ। সেটা এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকা আর নানাবিধ জার্নালে ঠাসা। অন্য পাশে একটা অ্যাপল কম্পিউটার। একটা স্ট্যান্ডওয়ালা ফ্যান ঘুরছে। মাঝখানে একচিলতে বারান্দা।
হুমায়ূন আহমেদ গদিতে আয়েশ করে বসতে বসতে বলেন, শুরু করো। এরপর আমাদের কথোপকথন শুরু হয়।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: প্রথম আলোর ঈদসংখ্যায় আপনার মেঘের ওপর বাড়ি উপন্যাসটি পড়েছি। ভালো লেগেছে। আপনার অন্য উপন্যাসের তুলনায় অন্য রকম।
এ ধরনের আরেকটা বই আমি লিখেছিলাম। বইটার নাম যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ। এক লোক তাঁর বউকে খুন করে। মৃত বউয়ের সঙ্গে কথাবার্তা বলে।
মেঘের ওপর বাড়ি বইটা লিখতে গিয়ে প্রধান যে সমস্যা হয়েছে, সেটা ধর্মীয়। মৃত্যুর পরবর্তী জগ ৎ নিয়ে যদি আমি এমন কিছু লিখি, যেটা ধর্মের সঙ্গে মেলে না, তাহলে ধর্মবিশ্বাসী লোকজন তো রাগ করবে। তবে এই বিষয় নিয়ে আগেও বই লেখা হয়েছে। আমাদের এখানে প্রথম এই বিষয় নিয়ে যিনি লেখেন, তিনি বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়। বইটার নাম দেবযান। এই বইয়ে তিনি মৃত্যুর পরের জগতের অনেক বর্ণনা দিয়েছেন। মৃত্যু নিয়ে প্রায়ই ভাবি। মৃত্যুর পরের জগ ৎ নিয়েও অনেক ভাবনা-চিন্তা করেছি। সম্ভবত এটা থেকেই মেঘের উপর বাড়ি বইটার ভাবনা মাথায় এসে থাকবে।
ট্রেতে করে চা আসে। তিন কাপ। এই ফাঁকে সঙ্গী আলীম আজিজ প্রসঙ্গ পাল্টান
আলীম আজিজ: দীর্ঘদিন ধরে আপনি লেখালেখি করছেন, এখন পেছনে তাকালে কী মনে হয়?
আলীম আজিজ: অতীতের অনেক তুমুল জনপ্রিয় লেখক কালের গর্ভে হারিয়ে গেছেন।
হুমায়ূন আহমেদ: আমি অত্যন্ত ভাগ্যবান। লেখক হিসেবে আমার আজ প্রায় ৪০ বছর হয়ে গেল। অথবা আরেকটা ব্যাপার হতে পারে, এত দিনে আসলে আর কোনো লেখক তৈরি হয়নি।
আমি নিজেকে মনে করি নতুন লেখকদের জন্য একটা বিভীষিকা। কথাটা বুঝিয়ে বলি। বিভীষিকা এই অর্থে যে, পাঠক বই কেনে লাইব্রেরি থেকে। বইয়ের বিক্রেতারা যেসব বই বিক্রি হবে, সেগুলো সাজিয়ে রাখে। যেগুলো বিক্রি হয় না, সেগুলো রাখে না। তারা তো সাহিত্যসেবা করতে আসেনি। তারা চায় বই বিক্রি করতে। আমার নতুন বই বের হবে, আমি জায়গা দখল করব। দখলকৃত জায়গার পরিমাণ বাড়তেই থাকবে। অন্যদের বই প্রদর্শন করারই সুযোগ নেই। এই অর্থে আমি একটা বিভীষিকা।
আরেকটা ভুল কথা আমার সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে। আমি নাকি বইয়ের পাঠক বাড়িয়েছি। আমি কিন্তু পাঠক বাড়াইনি। পাঠক বাড়ালে তো সবার বই-ই বেশি বেশি বিক্রি হতো। আমি শুধু আমার নিজের পাঠক বাড়িয়েছি। পাঠক যদি বাড়াতাম, তাহলে তো সব বইয়ের বিক্রি বাড়ত।
পড়ার ব্যাপারটা খুবই ব্যক্তিগত একটা বিষয়। যে বইটা তুমি পড়তে চাও না, সেটা তোমাকে বিনা পয়সায় উপহার দিয়ে সঙ্গে ২০০ টাকা দেওয়া হলেও তুমি বইটা পড়বে না। জোর করে আর যা-ই হোক, কখনো বই পড়া হয় না।
আলীম আজিজ: কলম্বিয়ার বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস একটা বয়সে এসে ঘোষণা দিয়েছিলেন লেখালেখি ছেড়ে দেওয়ার। আপনার কি সে রকম কিছু মনে হয়েছে?
হুমায়ূন আহমেদ: আমারও প্রায়ই মনে হয়, একটা ঘোষণা দিয়ে লেখালেখি ছেড়ে দিই। ছেড়ে দিয়ে বিশ্রাম করি। কিন্তু এটা হবে একটা লোক দেখানো ব্যাপার। কারণ, আমি জানি, লেখালেখি ছাড়া বেঁচে থাকাটা আমার জন্য অসম্ভব। এই যে শরীরটরীর খারাপ, তাও কাগজ-কলম নিয়ে বসেছি। যেহেতু লেখালেখি ছাড়া থাকতে পারব না, আলতু-ফালতু ঘোষণা দিয়ে তো লাভ নাই। সাধারণত, আমি যে কথা বলি, সেটা রাখার চেষ্টা করি। যেমন, আমি বলতে চাই, ঘেটুপুত্র কমলা আমার পরিচালিত শেষ ছায়াছবি।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: ছবিটির কাজ কি শেষ?
হুমায়ূন আহমেদ: ছবির সব কাজ শেষ। শুধু প্রিন্টটা করা হয়নি। প্রিন্ট হচ্ছে ব্যাংককে। প্রিন্টিংয়ে প্রচুর টাকা খরচ হচ্ছে। টাকার অঙ্কটা মোটামুটি আঁতকে ওঠার মতো।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: আপনার সাম্প্রতিক কিছু লেখা পড়ে মনে হয়েছে, অমরত্ব বিষয়ে আপনার আগ্রহ আছে। ২০৪৫ সালের মধ্যে অমরত্বপ্রাপ্তির উপায় আবিষ্কৃত হবে—আপনি লিখেছেন।
হুমায়ূন আহমেদ: এটা আমার কথা না। এটা বিজ্ঞানীদের কথা। আমিও বিশ্বাস করি। আমরা ক্রমশ সিঙ্গুলারিটির দিকে যাচ্ছি। কলম দাও, বুঝিয়ে বলি।
তাঁর হাতে বলপয়েন্ট কলম তুলে দিই। তিনি দারুণ আগ্রহের সঙ্গে কাগজে গ্রাফ এঁকে বোঝাতে শুরু করেন।
এই দেখো। ধরো, এই রেখাটা হচ্ছে টাইম। আর এই দিকে আছে বড় আবিষ্কার। সব ক্ষেত্রে আমাদের জ্ঞান বাড়ছে। আমরা এখন কাছাকাছি চলে এসেছি। ২০২১ সাল নাগাদ জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একটা বিস্ফোরণ হবে। এই বিস্ফোরণটাই হচ্ছে সিঙ্গুলারিটি।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: অমরত্ব যদি আমাদের নাগালে চলে আসে, ব্যাপারটা কেমন হবে?
হুমায়ূন আহমেদ: ইরিনা নামে একটা উপন্যাস আমি লিখেছি। সেখানে সবাই অমর। যেহেতু মানুষ অমর, তাই মানুষের উ ৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। আরও অনেক কিছু ঘটবে। এটার বড় ধরনের একটা সাইড এফেক্ট অবশ্যই থাকবে।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: অথবা এমন কি হতে পারে যে মানুষ একসময় সবকিছুতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলল? যেহেতু তার আর মৃত্যুঝুঁকি, অনিশ্চয়তা—এসব কিছুই থাকছে না।
হুমায়ূন আহমেদ: এ রকম কিছুও হতে পারে। পুরো বিষয়টাই আসলে খুব বিচিত্র। আজকেই পত্রিকায় পড়লাম। আমরা আসলে বর্তমানের চেয়ে সব সময় ৪০ মিলিসেকেন্ড পেছনে আছি। ৪০ মিলিসেকেন্ড লাগছে শরীরের সমস্ত বিষয়টা প্রসেস করতে। সব মিলিয়ে এত অদ্ভুত! আরেকটা কথা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। স্টিফেন হকিং বলছেন, বাইরের জগতের উন্নত প্রাণীর বিষয়ে চিন্তা না করাটাই ভালো। তারা যেন এখানে না আসে। আমরা চিন্তা করছি, তারা এখানে এলে ভালো হয়। আসলে সেটা হবে না। ওরা তো অভাবনীয় উন্নত প্রযুক্তি নিয়ে আসবে। আমরা উন্নত প্রাণী। গরু-ছাগল আমরা কেটে খাই, আমাদের প্রয়োজনে। অন্য বিশ্ব থেকে যারা আসবে, তাদের কাছে আমরা হব গরু-ছাগল। তখন সংঘাত অনিবার্য।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: আপনি কি মনে করেন, অন্য গ্রহে উন্নত প্রাণী আছে?
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: SETI (সার্চ ফর এক্সট্রা-টেরিস্ট্রিয়াল ইনটেলিজেন্স) নামের একটা সংগঠন আছে। ওরা ভিনগ্রহের প্রাণীর অস্তিত্ব অনুসন্ধান করে। ওরা কিন্তু এখনো সে রকম কিছু পায়নি।
হুমায়ূন আহমেদ: আমি জানি। কিন্তু ভিনগ্রহের প্রাণীদের যদি অন্য কোনো সিস্টেম থাকে, তাহলে তো আমরা ওদের ধরতে পারব না। ওদের কার্বন-বেসড লাইফ কেন হবে? ওদের সিলিকন-বেসড লাইফ হতে পারে। ওদের যদি ঠিক চোখ-কান না, অন্য কোনো সিস্টেম থাকে? তাহলে তো আমরা ওদের ধরতে পারব না।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: ঘেটুপুত্র কমলা ছবির বিষয়টা একটু ভিন্ন ধাঁচের। এই নামে একটি গল্প আপনি লিখেছিলেন। ছবিটি কি কোনো বিতর্ক তৈরি করতে পারে?
হুমায়ূন আহমেদ: মূলত, গল্পটা থেকেই এই ছবি। এখন তো এই কালচার নেই। গল্পে বিষয়টা আন্ডার কারেন্ট ছিল। ছবিতেও তা-ই। ছেলেটাকে নিয়ে দরজা বন্ধ করেছে, ওই পর্যন্তই। তবে পুরো বিষয়টা পরিষ্কারভাবে উঠে আসবে। আমার শুধু একটা অনুরোধ, বাচ্চারা যেন এই ছবিটা না দেখে। আমার ছেলে আমাকে প্রশ্ন করেছে, ঘেটুপুত্র ছেলে, না মেয়ে? আমি চাইছি না বাচ্চারা এই ছবিটা দেখুক। ছবিটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: কোনো ঘেটুপুত্রের সঙ্গে কি আপনার দেখা হয়েছে?
হুমায়ূন আহমেদ: হ্যাঁ, দেখা হয়েছে। ২০-২৫ বছর আগে তো হবেই। গল্পটা লিখেছি তারও পরে। জিনিসটা মাথায় ছিল। ঘেটুগান ছিল মূলত হাওরভিত্তিক। ওখানকার লোকদের তিন মাস কিছুই করার থাকে না। কর্ম ছাড়া একদল লোক কীভাবে বাঁচবে। তারা গানবাজনা করে। গানগুলোর সুর ক্লাসিক্যাল। একদম ক্লাসিক্যাল সুর। দাঁড়াও, তোমাদের শোনাই।
প্রধান সহকারী পরিচালক জুয়েল রানা এসে অ্যাপল কম্পিউটারের পর্দায় ঘেটুপুত্র কমলার গান বাজিয়ে দেন—‘পাখি উড়ি লো...উড়ি লো’। আমরা শুনি। গান শেষে আবার আলাপে ফিরি।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: আমি দেশের অনেক নামি জাদুশিল্পীর সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা আপনাকে দেশের শীর্ষস্থানীয় একজন পামিং (হাত সাফাই) শিল্পী হিসেবে স্বীকার করেছেন।
হুমায়ূন আহমেদ: পামিং। এটা শেখার জন্য বছরের পর বছর সাধনা করতে হয়। এখন আর কেউ সেটা করতে চায় না। আমার শুরুই হয়েছে পামিং দিয়ে। বছরের পর বছর আমি এর পেছনে সময় দিয়েছি। হাতের তালুতে পয়সা লুকানোর চেষ্টা করেছি।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: আপনার প্রিয় জাদুশিল্পী কে?
হুমায়ূন আহমেদ: অবশ্যই জুয়েল আইচ। ম্যাজিকের প্রতি তাঁর যে আগ্রহ, ডেডিকেশন, সেটার কোনো তুলনা হয় না। আচ্ছা, বলে রাখি, আমার জাপানি ভাষায় একটা বই প্রকাশিত হচ্ছে।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: এর আগে জাপানি টেলিভিশনে আপনার ওপর একটা তথ্যচিত্র প্রচারিত হয়েছে।
হুমায়ূন আহমেদ: হ্যাঁ। সেটা বহুদিন আগে। এই বইটার নাম বনের রাজা। বাচ্চাদের বই। আমাদের এখানে অলংকরণ করেছিল ধ্রুব এষ। যেসব প্রাণীর কথা বলা হয়েছে, ওরা সেগুলো তৈরি করেছে। তারপর সেগুলোর ছবি তুলেছে। খুব যত্ন নিয়ে করেছে বইটা।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: হিমু প্রসঙ্গে আসি। হিমুর এবারের বইয়ে দেখা যাচ্ছে, মাজারের হুজুরের কাছে হার্ভার্ড পিএইচডি বল্টু ভাই, মানে একজন বড় বিজ্ঞানী, গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছেন। মাজারে আসার পর তাঁর মাথার জট খুলে যাচ্ছে। আপনার অবচেতন মনে, এটা ছিল যে বিজ্ঞান সবকিছুর উত্তর দিতে পারে না?
হুমায়ূন আহমেদ: হ্যাঁ, পারে না। বল্টু ভাইয়ের মতো বই পড়েই আমরা সবকিছু জানতে পারব না। যেমন, ওই হুজুর বলেছেন, যে চিনি খায়নি সে কি বই পড়ে বুঝতে পারবে চিনির কী স্বাদ? ধর্ম এবং বিজ্ঞান দুটোই রহস্যময়।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: আপনার লেখার মধ্যে এমনিতে মোটা দাগে কোনো ফর্মুলা খুঁজে পাওয়া কঠিন। কিন্তু অনেক সময় আপনাকে পাঠক ধরে রাখার কিছু সহজ কৌশল অবলম্বন করতে দেখি। ধরা যাক, সাধারণ একটা লোকজ ধাঁধা আপনি বইয়ের শুরুতে ব্যবহার করছেন। যার উত্তর মেলে বইয়ের শেষের দিকে। এটা কি সচেতনভাবে করেন?
হুমায়ূন আহমেদ: এটা আসলে পাঠকের আগ্রহ ধরে রাখার জন্য করি। একটা পৃষ্ঠা পড়ার পর পাঠক যাতে পরের পৃষ্ঠাটা পড়ে। কৌশলটা যে খুব ভালো, তা বলব না। তলস্তয়ের ওয়ার অ্যান্ড পিস। প্রথম দেড় শ পৃষ্ঠা আমার কাছে খুবই একঘেয়ে মনে হয়েছে। পাতার পর পাতা শুধুই একটা পার্টির বর্ণনা। কিন্তু যখন তুমি গল্পটার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছো, তখন তুমি বারুদের গন্ধ পাবে। যুদ্ধটাকে অনুভব করতে পারবে। আমি প্রথম পৃষ্ঠায় আটকে ফেলতে পেরেছি, তার মানে আমি বিরাট লেখক এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। জাপানি লেখক হারুকি মুরাকামির একটা বই পড়ছি। পড়ে মুগ্ধ হলাম। তার গল্প বলার ধরন অসাধারণ। খুব সহজ কথা বলছে, কিন্তু একই সঙ্গে এত গভীর কথা বলে যাচ্ছে।
আলীম আজিজ: আপনি ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন?
হুমায়ূন আহমেদ: ঈশ্বরবিশ্বাস আমার আছে। ধরা যাক, তুমি একটা গ্রহে গেছ। গ্রহটা দেখে তোমার মনে হতে পারে, চিরকাল ধরে গ্রহটা একই রকম আছে। কিন্তু সেখানে গিয়ে তুমি যদি একটা নাইকন ক্যামেরা দেখ, তোমাকে সেটা হাতে নিয়ে বলতেই হবে, এটার একজন কারিগর বা মেকার আছে।
সামান্য একটা প্লাস্টিকের ক্যামেরা দেখে তুমি বলছো এর একটা মেকার আছে। ক্যামেরার কিন্তু অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। তোমার পেছনে একটা মানুষ আছে। ক্যামেরায় পেছনের মানুষটাকে ফোকাস করার সঙ্গে সঙ্গে তুমি হয়ে যাবে আউট অব ফোকাস। আবার তোমাকে ফোকাস করার সঙ্গে সঙ্গে পেছনের জন হবে আউট অব ফোকাস।
মানুষের চোখের কিন্তু এই অসুবিধে নেই। চোখ ক্যামেরার চেয়ে বহুগুণ শক্তিশালী। আমাদের শরীরে একটা যন্ত্র আছে, যার কাজ শরীরের সুগার-লেভেল ঠিক রাখা। মানুষের পুরো শরীর এমন বিচিত্র আর জটিল যন্ত্রপাতিতে ভরপুর। এসব জটিল ব্যাপার এক দিনে এমনি এমনি হয়ে গেছে, এটা আমার মনে হয় না। ‘ডারউইন থিওরি’ কী বলে? বলে, সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট। বলে, পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে মানুষের সামনে নানা রকম বিপত্তি আসবে, সেগুলো জয় করতে গিয়ে আমরা এ রকম হয়ে গেছি। পশুর চোখ কিন্তু হলুদ। আর আমাদের চোখ সাদা। এটা হয়েছে, যাতে মানুষ অন্ধকারের মধ্যে নিজেরা নিজেদের চিনতে পারে। আমাদের টিকে থাকার জন্য এইটুকু জ্ঞানই তো যথেষ্ট ছিল। কিন্তু মানুষের মাথায় এই জ্ঞান কীভাবে এল যে সে রীতিমতো ‘বিগ ব্যাং থিওরি’ আবিষ্কার করে ফেলল? এই এক্সট্রা-অর্ডিনারি জ্ঞানটা মানুষকে কে দিল? খেয়াল করলে দেখা যাবে, মানুষ সবার আগে যে বাড়িটা বানায়, সেটা একটা প্রার্থনাকক্ষ। সব জাতির মানুষের ক্ষেত্রেই তা-ই। তার মানে, সেই একদম শুরু থেকেই মানুষ আসলে একটা ব্যাপার নিয়ে চিন্তিত—হু ইজ গাইডিং মি?
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: মৃত্যুর পরবর্তী জগ ৎ নিয়ে আপনার নিজের চিন্তাভাবনা কী?
হুমায়ূন আহমেদ: এই বিষয়ে আমার প্রবল একটা আগ্রহ সব সময় ছিল। একবার আমি চেষ্টা করলাম প্রার্থনা করব। প্রতিদিন একটা সময়ে বসি। পৃথিবী থেকে বিদায়মুহূর্তটা কেমন হবে, এটা জানা যায় কি না চেষ্টা করি। দিনের পর দিন এটা চলল। তখন আমি একটা স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্ন আমাকে দেখানো হলো। অথবা আরেকটা ব্যাপার হতে পারে, দিনের পর দিন একটা ব্যাপার চিন্তা করার ফলে আমার মস্তিষ্ক সেটা তৈরি করল। অনেক বড় বিজ্ঞানীর বেলায়ও এটা হয়েছে।
আমি কী স্বপ্নে দেখেছি সেটা বলি—
বিশাল একটা হাওর। হাওরের মধ্যে পানি, পানি আর পানি। কলাগাছের মতো একটা জিনিস ধরে আমি ভাসছি। পানি অল্প ঠান্ডা। কলাগাছের মতো জিনিসটা মনে হচ্ছে একটা যান। সেটা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। কিছুদূর গিয়ে মনে হলো—মাই গড! এ তো আনন্দের পৃথিবী ছেড়ে আমি চলে যাচ্ছি! সঙ্গে সঙ্গে যাত্রা বন্ধ হলো। আবার ফিরে এলাম। আমার এই বাড়িঘর—সব আগের মতো। আমি দেখলাম। তখন আমার মনে হলো—আর কী? এবার যাই। আমার যাত্রা আবার শুরু হলো। অনেক দূর গিয়ে আবার মনে হলো—ও মাই গড! সব ফেলে আমি কোথায় যাচ্ছি! আবার ফিরে এলাম। তারপর আবার মনে হলো—এই তো সব। আর কী? এরপর যানটা একটা অকল্পনীয় গতিতে ছুটতে শুরু করল। কোন দিকে যাচ্ছি, কিছুই বুঝতে পারছি না। দূরে ছোট্ট একটা আলো।
এটাই হচ্ছে আমার অভিজ্ঞতা। হতে পারে, আমার মস্তিষ্ক এটা তৈরি করেছে। আবার না-ও হতে পারে।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: মেঘের ওপর বাড়ি বইয়ের কেন্দ্রীয় চরিত্রকে আমরা দেখি, নিয়ন্ত্রণ করছে অন্য একজন।
হুমায়ূন আহমেদ: আমরা তো সাধারণ মানুষ। রবীন্দ্রনাথ কী বলে গেছেন? বলে গেছেন, আমি তো লিখি না, জীবনদেবতা আমাকে দিয়ে লেখান। আবার, এমনও হতে পারে, আমরা খুব অসহায় বোধ করি বলেই একজন বড় পথনির্দেশকের কথা চিন্তা করি।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: আপনি দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন। দেশটা আপনার কেমন লাগে?
হুমায়ূন আহমেদ: ওখানে যাওয়াটা আমার জন্য ভয়ের ব্যাপার। দীর্ঘ বিমান ভ্রমণ খুবই ক্লান্তিকর। আর বিমান ভ্রমণ আমার জন্য এমনিতেই আতঙ্কজনক। কারণ আমার উচ্চতাভীতি আছে। সারাক্ষণ মনে হতে থাকে—এই বুঝি সব ভেঙেচুরে নিচে পড়ে যাব।
দুপুর দুইটা মতো বাজে। আমরা আলাপ শেষে ‘দখিন হাওয়া’ থেকে বেরিয়ে আসি।ঘণ্টা চল্লিশেক পরে তিনি উড়াল দেবেন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে।
সাক্ষা ৎকার গ্রহণের তারিখ: ১২-০৯-২০১১
ভিডিও
যারা কোন এক দীপন-নন্দীর (ফাসিক বটে!) সুযোগসন্ধানী বক্তব্য দিয়ে হুমায়ুন আহমেদকে নাস্তিক বানিয়ে প্রচারনা চালাচ্ছেন তারা ধৈর্য্য ধরে এই ইউটিউব ভিডিওর পুরোটা দেখবেন অবশ্যই। শুরুতে আপনার কিছুটা অস্বস্তি যদি লাগেও একটু কষ্ট করে শেষ করুন। বাংলার এই রত্নকে দয়া করে নিজেদের অহেতুক শত্রুতে পরিনত করে কোনভাবে লাভবান হবেন না, না পার্থিব দিক দিয়ে না আপনার দ্বীনের দিক দিয়ে। মনে রাখবেন, হুমায়ুন আহমেদ বিরাট বুজুর্গ-ও নন আবার অবিশ্বাসী নাস্তিক ও নন। ধর্মবিশ্বাসের দিক দিয়ে স্রেফ বাংলাদেশের মুসলমানদের অন্তত ৫০% এর মত স্রেফ একজন সাধারন মানুষ। (Link)
ভারতীয় পণ্য ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে যখন বাংলাদেশের প্রতিটা সেক্টর বিপর্যস্ত তখন একজন হুমায়ুন আহমেদ ছিলেন আমাদের যিনি পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুত্ববাদী অশ্লীল সাহিত্বের বাজারকে প্রতিরোধ করেছিলেন আমাদের প্রকাশনা শিল্পে। হুমায়ুন আহমেদ শিখিয়ে গেছেন কেবল পল্টনী আর বায়তুল মোকাররমী শ্লোগানসর্বস্ব হুশিয়ারী দিয়ে আগ্রাসন প্রতিরোধ করা যায় না। আগ্রাসন প্রতিরোধ করতে হলে সত্যিকারের কাজ করার যোগ্যতা থাকতে হয় যা আগ্রাসীর পণ্যের চেয়ে অধিক মানসম্পন্ন ও গ্রহণযোগ্য। আসুন আমরা সতর্ক থাকি যেন হুমায়ুনের অনুপস্থিতিতে ভারতীয় সমরেশ সুনীল বুদ্ধদেবেরা আবার আমাদের পাঠ অভ্যাসে ঢুকে পড়তে না পারে। আসুন আমরা আমাদের শিক্ষাঙ্গন, আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গন, আমাদের রেডিও টেলিভিশন, আমাদের ইন্টারনেট জগত্, আমাদের সীমান্ত, আমাদের বাচ্চাদের কার্টুন, আমাদের প্রতিটি সেক্টরে এমন কন্সট্রাকটিভ ও অধিক মানসম্পন্ন কাজের মাধ্যমে প্রতিরোধ গড়ে তুলি। কেবল নীতিকথা শুনিয়ে মানুষের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। (Link) "আল্লাহ, হুমায়ুন আহমেদ এর ভুল ত্রুটি ক্ষমা করে দিন। আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি তিনি একজন অত্যন্ত প্রতিভাবান ও মার্জিত রূচীর সাহিত্যিক ছিলেন। এবং তার বেশিরভাগ লেখনী প্রমাণ করে তিনি একজন ইমানদার তথা বিশ্বাসী মানুষ ছিলেন। রাজনৈতিক জুলুম সন্ত্রাস ও অন্যায়ের বিরুদ্ধেও নানা সময় কলম ধরেছেন তিনি। বিকৃত মিথ্যা ইতিহাসের বিরুদ্ধে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরেছেন বারবার তার চলচ্চিত্র ও উপন্যাসে। মানুষকে নির্মল রূচীসম্পন্ন আনন্দ বিতরণকারী, বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটির একটুকরা মূল্যবান সম্পদ হুমায়ুন আহমেদকে যথোপযুক্ত পুরষ্কার আপনি দিন হে আল্লাহ!"
হুমায়ুন আহমেদ! কিছু স্মৃতি ও শুভ কামনা।
হুমায়ুন আহমেদ, নিজ কল্পনার আয়নায় যিনি বাদশাহ নামদার।
অগণিত জনের একান্ত প্রিয় একজন মানুষ।
তিনি আর নেই। চিরকালের জন্য ছেড়ে গেছেন আমাদের।
একজন অসাধারণ মানুষের সগৌরব প্রস্থান। অনেক দিন থেকে তিনি জানান দিয়ে, আমাদেরকে মানসিক ভাবে প্রস্ত্তুত করে তারপর পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন।
যাবার আগে একবার নিজ দেশ, জন্মদাত্রী মা, এবং সকল শুভাকাংখীদের দেখে গেলেন দু’চোখ ভরে। শেষবার দেশে আসার পর,(মাস খানেক আগে)যখন দেয়াল উপন্যাস নিয়ে বেশ বিতর্ক হল তখন আমার সৌভাগ্য হয়েছে তার একটি টেলিফোন কল পাওয়ার। তাই কিছুতেই কষ্ট থামাতে পারছিনা। এখনো যেন কানে ভাসছে সে সহজ-সরল কথোপোকথন।
সাহিত্যের মানুষ না হয়েও যিনি বাংলা সাহিত্যের পরম বন্ধু, কালের সম্রাট। বাংলাদেশে কলকাতা কেন্দ্রিক সাহিত্যের আধিপত্য ম্লান করে দিয়ে যিনি গল্প ও সাহিত্য প্রেমিক তরুণ-যুবা দের নিজ দেশের বই পড়ার আকর্ষণ তৈরী করেছেন।
তাকে যারা পছন্দ-কিংবা অপছন্দ করেন, সম্ভবত: সবাই আজ খুব ব্যথিত।
শ্রদ্ধেয় হুমায়ুন আহমেদ হাসতে হাসতে গেছেন কিনা জানিনা, তবে যাবার সময় তিনি সবাইকে কাদিয়েছেন।
স্যার কে ঘিরে অনেক স্মৃতি মনে পড়ছে আজ।
বেশ কয়েক বছর আগে এক রমজান মাসের মাঝামাঝি সময়ে হুমায়ুন আহমেদের বাসায় গিয়েছিলাম ঈদুল ফিতরের একটি নাটক প্রসঙ্গে আলাপের জন্য। আমার যে পরিচয় তাতে তিনি সহজাত স্বচ্ছন্দে তার বাসভবনে আমাকে গ্রহণ করার কথা নয়, প্রথমাবস্থায় করেন-ও নি। শুরুতেই তার তাচ্ছিল্য ও অবজ্ঞামূলক অভিব্যক্তি প্রকাশ পেল এবং তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন ঈদের নাটকে তিনি সহযোগিতা করবেন না। আমরা ছিলাম ৩জন। আমি, বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনের বিখ্যাত মানুষ-কীর্তিমান কবি ও সাহিত্যিক শ্রদ্ধেয় মাহবুবুল আলম গোরা এবং জনপ্রিয় অভিনয় শিল্পী স্যারের স্নেহধন্য ডা: এজাজ।
যাই হোক, শেষ পর্যন্ত শ্রদ্ধেয় মাহবুব ভাইয়ের সৌজন্যে হুমায়ুন স্যার আমাদের বেশ গুরুত্ত্ব দিলেন এবং একপর্যায়ে গল্প খুব জমে উঠেলো। সেদিনই টের পেলাম হুমায়ুন আহমেদ কত আড্ডাপ্রিয় একজন মানুষ। আমাদের আড্ডায় একপর্যায়ে শামীল হলেন স্যারের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন-ও। সেদিনের সেই কথপোকথন, নানা মজার আলোচনা আমি কখনো ভুলবোনা। হুমায়ুন স্যার সেদিন(সম্ভবত: আমাকে দেখে) ইসলাম সম্পর্কে কনফিউশন(সংশয়) সৃষ্টি করতে পারে এমন বিষয়গুলো নিয়েই বেশী আলোচনা করলেন। তিনি যে কত প্রাজ্ঞ এবং বৈচিত্রময় জ্ঞানের ভান্ডার তা বাস্তবে অনুভব করলাম। আলোচনা অতি প্রাকৃতিক বিষয় থেকে গভীর দর্শনে ঘুরপাক খাচ্ছিল। স্রষ্টার নীতি-কতৃত্ত্ব-পরকাল-বর্তমান কিছুই বাদ গেলোনা।
কখনো তাকে মনে হচ্ছিল অতি নিষ্ঠাবান আস্তিক আবার পরক্ষনেই তিনি সংশয় ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন।
এরকম একজন মানুষের সামনে কি কথা নিয়ে দাড়ানো যায়!
এসব যখন ভাবছিলাম তখন খুব সুন্দর করে মাহবুবুল আলম গোরা বললেন, হুমায়ুন ভাই আপনি তো বিজ্ঞানের ছাত্র, জীবনের বৈচিত্র-জীবন দর্শন সব নিয়ে বেশ ভাবেন। একটি বিষয় নিয়ে আমার প্রায়ই ভাবনা হয়, সেটা হচ্ছে স্বপ্ন!
আচ্ছা বলুন তো স্বপ্নে আমরা আসলে কোথায় থাকি?
স্বপ্নটা আসলে কী!
এটা কি ভার্চুয়াল কোন জগত না আসলে ক্ষণিকের জন্য আমরা অন্য কোথাও প্রত্যাবর্তিত হই। স্বপ্নে আমি প্রায়ই আমার মরহুমা মা’কে দেখি।
তার সাথে অনেক কথা হয়।
হুমায়ুন স্যার তন্ময় হয়ে মাহবুব ভাইয়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। কোন উত্তর করলেন না। তারপর একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন- এ ইহ-জাগতিক অনেক কিছুরই ব্যখ্যা নেই মাহবুব ভাই।
আমি খুব পুলক অনুভব করলাম।
এর আগে স্যার কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন “ ডিভাইন গাইডেন্স আবার কী, এটা কেন প্রয়োজন? আমার জ্ঞান আছে, মেধা আছে-সেটা দিয়ে আমি নিজের পথ ঠিক করবো। চাপিয়ে দেয়া গাইডেন্স কেন দরকার?”
এবার সে কথার পূণ:সূত্র টেনে আমি কিছুটা বোকা সেজে বললাম, স্যার একটি বিষয়ে আমার ও খুব ভাবনা হয়, জবাব পাইনা।
-কী সেটা?
-আমার(নিজ হাত, মাথা দেখিয়ে) এ হাত-এ মাথা তো আমার, তাই না!
তিনি সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন।
-কিন্তু আমার হাত, মাথা বা অন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গুলো সব-সময় তো আমার ডিরেকশন ফলো করেনা।
-কেমন?
আমি বললাম আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই আমার হাত-মাথা বা পেট কখনো কখনো ব্যথা করে, আমি চাইনা অথচ আমারই হাত-মাথা আমার প্রতিকূল আচরণ করে কেন?
স্যার আবার আগের মত নিশ্চুপ হয়ে যান। কিছুটা ভেবে মুখে মৃদু হাসির রেখা টেনে বলেন আপনি খুব চালাক। এসব বিষয় নিয়ে একদিন সময় নিয়ে আসলে কথা বলবো।
তারপর তিনি আমাদের কে অবাক করে দিয়ে বললেন যান আপনাদের জন্য একটি নাটক আমি দেব। মাহবুব ভাইয়ের হাত ধরে তিনি বললেন খুব ভালো লাগলো মাহবুব ভাই। মাঝে মাঝে আসলে গল্প করা যাবে। সেদিন তিনি আমাদের কে বাইরে এসে লিফট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেলেন। আমরা সংকোচ করাতে স্মরণ করিয়ে দিলেন এটাতো নবীজির সুন্নাত।
সেবার ঈদের পূর্বে মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে স্যার “আইনস্টাইন এবং” নামে একটি নাটক আমাদের কে তৈরী করে দিয়েছিলেন যা ছিল অবিশ্বাস্য।
গত ঈদে স্যার আমাদের জন্য আরেকটি নাটক দেয়ার কথা ছিল, কিন্তু শেষ মুহুর্তে শারীরীক অসুস্থতার জন্য দিতে পারেননি বলে মাহবুব ভাইকে ফোন করে সরি বলেছিলেন। এত বড় একজন মানুষের এ বদান্যতা সত্যিই ভুলার নয়। আমরা অবশ্য বেকায়দায় পড়ে অবশেষে তাকে কেন্দ্র করে “হুমায়ুনের মসনদ” নামে একটি নাটক করেছিলাম। মাহবুব ভাইয়ের অনুরোধে আমাকেই সে নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখতে হয়েছিল। স্যার শুনলে যাতে রাগ না করেন সেজন্য ডা: এজাজ কে আমরা হুমায়ুন চরিত্রে অভিনয় করিয়েছিলাম। আজ এসব ভেবে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে।
স্যার একবার ফোন করে তার সহকারী কে পাঠালেন আমাদের অফিসে। সে অনেক অব্যক্ত ইতিহাস, আমরা চেষ্টা করেছিলাম স্যারের পুরোনো পরিবার, তার মেয়েদের সাথে তার সম্পর্ক উন্নয়ন করার জন্য। স্যারের একান্ত ভক্ত দিগন্ত টেলিভিশনের হেড অব ব্রডকাস্ট আবুল হাসান এ ব্যপারে খুব অনুপ্রেরণা দিতেন আমাদের।
সবার অলক্ষে অনেক কষ্ট করেছিলাম আমরা। ডা: এজাজ ছিলেন এসব ব্যপারে খুব আন্তরিক কল্যানাকাংখী।
আজ সবই দূ:খময় স্মৃতি।
জীবনের কঠিন বাস্তবতায় হুমায়ুন আহমেদ আজ অতীত।
পরকালের যে অনিবার্য বাস্তবতা, তাতে তিনি কতটুকু সফল বা অসফল জানিনা। যে সংশয়ের দোলায় তিনি দোল খেতেন-ছিল কী সেখানে কোন অন্তিম উপলব্ধি?
তার কোন অপ্রকাশিত লেখায় হয়তো পাওয়া যাবে শেষ অনুভুতির ইংগিত।
চর্ম-চক্ষুর বিচার সাধারণের জন্য।
হুমায়ুন স্যার অসাধারণ-অন্যরকম একজন।
তার জন্য শুধু শুভ কামনা ছাড়া আজ আর কিছু-ই ভাবতে পারছিনা।
স্যার, আপনার ইহকালের মত পরকাল ও যদি গৌরবময় হয় তাহলে খুব, খু-উ-ব খুশী হবো।
0 comments: