জহির রায়হান অন্তর্ধান নাকি হত্যাকান্ড?-৩

৫ ফেব্রুয়ারি ২০০০ দৈনিক ইনকিলাবের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি মিরপুর যাওয়ার পর জহির রায়হান নিখোঁজ হন। জহির রায়হানের অন্তর্ধানকে হত্যাকান্ড হিসেবে বর্ণনা করে সেই হত্যাকান্ডের দায়দায়িত্ব (তাদের ভাষায়) রাজাকারদের উপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রায় মাস দেড়েক আগে গত ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে মেজর জেনারেল (অব.) হেলাল মোর্শেদ, মেঃ জেঃ (অব.) মঈন, মেঃ জেঃ (অব.) ইব্রাহিম প্রমুখ অফিসার বলতে চেয়েছেন যে, মিরপুরে ৩০ জানুয়ারি বিহারীদের গুলীতে তিনি নিহত হয়েছেন। কিন্তু জহির রায়হান অন্তর্ধান রহস্য ঘাঁটতে গিয়ে এমন কিছু ব্যক্তির এমন কতগুলো চাঞ্চল্যকর তথ্যের সন্ধান পাওয়া গেল যেগুলো পড়ে শরীরের লোম খাড়া হয়ে ওঠে। এসব তথ্য পাওয়া গেছে নিখোঁজ জহির রায়হানের প্রথম স্ত্রী সুমিতা দেবী, দ্বিতীয় স্ত্রী সুচন্দার ভগ্নী, চলচ্চিত্র নায়িকা ববিতা, জহির রায়হানের ভাবী আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য পান্না কায়সার এবং এই সময়কার সবচেয়ে বড় ঘাদানিক নেতা শাহরিয়ার কবির প্রমুখের কাছ থেকে।
এ ছাড়াও এদের জবানীতে সত্যজিৎ রায় এবং শেখ মুজিবের যেসব উক্তি উদ্ধৃত করা হয়েছে সেসব পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, জহির রায়হান ৩০ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেননি। তারপরেও বেশ কয়েকদিন তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল। এদের বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে, তিনি বাংলাদেশ এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর বেস্টনীর মধ্যেই ছিলেন। ঘটনা পরম্পরা পর্যালোচনা করলে তার মৃত্যুর দায়দায়িত্ব তৎকালীন প্রশাসনকেই গ্রহণ করতে হয় এবং (তাদের ভাষায়) রাজাকার বা দালালদের উপর কোনভাবেই চাপানো যায় না। এই সংবাদ ভাষ্যে ইনকিলাব-এর নিজস্ব মন্তব্যের পরিবর্তে উপরে উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গের উদ্ধৃতি এবং মন্তব্য ব্যাপকভাবে তুলে ধরা হচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ যখন অপপ্রচার এবং উস্কানিমূলক প্রচারণার বিষবা আচ্ছন্ন তখন এসব ব্যক্তিবর্গের সেদিনের উক্তি এবং আজকের ভূমিকা মিথ্যা প্রচারণায় বিভ্রান্ত মানুষকে সত্যের আলোকবর্তিকা দেখাতে সাহায্য করবে।'

সেই সময়কার সরকার নিয়ন্ত্রিত সাপ্তাহিক বিচিত্রায় বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল। সংখ্যাটি ছিল ১৯৯২ সালের ১ মে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন শাহরিয়ার কবির। তাদের সংলাপের অংশবিশেষ নিচে তুলে ধরা হলো : সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে সত্যজিত রায় শাহরিয়ার কবিরকে হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করলেন,
-জহিরের ব্যাপারটা কিছু জেনেছো?

-তাকে সরিয়ে ফেলার পেছনে ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। আমরা ব্যক্তিগতভাবে তদন্ত করে যা বুঝতে পেরেছি তাতে বলা যায়, ৩০ জানুয়ারি দুর্ঘটনায় তিনি হয়তো মারা যাননি। তারপরও দীর্ঘদিন তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন।
-স্ট্রেঞ্জ! জহিরকে বাঁচিয়ে রাখার পেছনে কারণ কি?
-সেটাই ষড়যন্ত্রের মূল সূত্র বলে ধরছি। মিরপুরে দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হলে গভীর ষড়যন্ত্র মনে করার কোনো কারণ ছিল না। আমি যতদূর জানি, বুদ্ধিজীবীদের হত্যার তদন্ত করতে গিয়ে তিনি এমন কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন যা অনেক রথী-মহারথীদের জন্যই বিপজ্জনক ছিল, সে জন্য তাকে সরিয়ে ফেলার প্রয়োজন ছিল।

১৯৯২ সালেও শাহরিয়ার কবির মনে করতেন যে, জহির রায়হানকে ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারির পরেও দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল। তাহলে আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরা বলুন যে, স্বাধীন বাংলাদেশে জহির রায়হানকে আটকে রাখার ক্ষমতা কাদের? বলা হচ্ছে যে, বুদ্ধিজীবী হত্যার তদন্ত করতে গিয়ে জহির রায়হানের হাতে এমন কিছু তথ্য এসেছিল যেটা রথী-মহারথীদের জন্য ছিল বিপজ্জনক। স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী সরকারের আমলে কারা ছিলেন রথী-মহারথী? যে বিপজ্জনক তথ্যের জন্য তাকে সরিয়ে ফেলার প্রয়োজন হয়েছিল। সেসব তথ্য কাদের জন্য বিপজ্জনক ছিল? তাদের ভাষায় রাজাকার এবং পাকিস্তানী দালালদের রাজনীতি তো নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কারা তাহলে জহির রায়হানকে সরিয়েছে?

পান্না কায়সার জহির রায়হানের বড় ভাই পরলোকগত শহীদুল্লাহ কায়সারের স্ত্রী। বাংলা ১৩৯৯, ১০ জ্যৈষ্ঠ, ইং ১৯৯২ দৈনিক বাংলার বাণীতে তিনি একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘কবিতা মিলনকে মিথ্যা সান্ত্বনা।' এই নিবন্ধে তিনি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আবু সাঈদ চৌধুরীর স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট সেলিম সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়েছেন। আলোচ্য নিবন্ধের এক স্থানে পান্না কায়সার বলেছেন, ‘৩০ জানুয়ারি জহির রায়হান একটি ফোন পেয়ে মিরপুর ছুটে গিয়েছিলেন। একথা বহুবার লেখা হয়েছে, বলা হয়েছে। কিন্তু বলা হয়নি সেলিমের কথা। সেলিমও নাকি সে রকমই একটি ফোন পেয়ে প্রেসিডেন্ট আবু সাঈদকে না বলেই জহির রায়হানের সঙ্গে মিরপুরে ছুটে গিয়েছিলেন। তারপর দু'জনের ভাগ্যে একই নিষ্ঠুর পরিণতি। দু'জনই নিখোঁজ। সেলিমের মা এ সংবাদ পেয়ে প্রেসিডেন্ট আবু সাঈদ চৌধুরীর কাছে ছুটে গিয়েছিলেন। সেলিম বঙ্গভবনের যে ঘরটিতে থাকতেন ইত্যবসরে সে ঘর থেকে সমস্ত কাগজপত্র, কাপড়-চোপড় উধাও। শহীদ সেলিমের মা অনেক কষ্ট করেও কোন রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি। রহস্য রহস্যই থেকে গেল। জহির রায়হান নিখোঁজ হবার পর বুদ্ধিজীবী হত্যার কোন রকম কাগজপত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি। কাগজগুলোর কোন হদিসই পাওয়া গেল না। পাওয়া গেলে হয়তো পরবর্তীতে তদন্ত কমিটির অন্য কেউ কাজে লাগাতে পারতেন। শহীদ সেলিমের মায়ের মতে, বঙ্গভবনের ওর ঘর থেকে যে প্রয়োজনীয় কাগজগুলো উধাও হয়েছিল সেগুলো সম্ভবত তদন্ত কমিটির গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রই হবে। খোদ বঙ্গভবন থেকে জিনিসপত্র উধাও হয়ে যাবে তা ভাবতেও বিশ্বাস হয় না। শহীদ সেলিম বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্তের কাজে সরাসরি জড়িত ছিলেন একথা আমি আগ থেকে জানতাম না। আমি ছাড়া আর কেউ জানে কিনা তাও জানি না। জহির রায়হান ও সেলিমের নিখোঁজ রহস্য এখন আমার কাছে আরো রহস্যজনক মনে হচ্ছে। বুদ্ধিজীবী হত্যার যেমন ১৯৭২ সালের গুরুত্বের সঙ্গে উদঘাটিত হয়নি, তেমনি জহির রায়হান নিখোঁজ রহস্যও গুরুত্বের সঙ্গে উদঘাটিত করার প্রয়োজনীয়তা কেউ অনুভব করেনি। অথচ এটা একটা গভীর ষড়যন্ত্র। যে ষড়যন্ত্রের বিষবৃক্ষের বীজ রোপণ হয়েছিল সেদিন।'

পান্না কায়সার নিজেই বলেছেন যে, খোদ বঙ্গভবন থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র উধাও হয়ে যাবে সেটা ভাবনারও অতীত। জহির রায়হানের সাথে লেফটেন্যান্ট সেলিমও বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্তে সরাসরি জড়িত ছিলেন। এ সম্পর্কিত কাগজপত্র জহির রায়হান ও সেলিম উভয়ের কাছ থেকেই উধাও হয়ে গেছে। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রেসিডেন্টের ভবন থেকে কাগজপত্র উধাও করতে পারে কারা? রাজাকার বা পাকিস্তানপন্থীরা অবশ্যই নয়। এটা করা সম্ভব একমাত্র তাদের পক্ষে, যারা ক্ষমতার আশেপাশে ছিলেন।

‘জহির রায়হানের মৃত্যু-বানোয়াট গল্প' শীর্ষক লেখায় (দৈনিক দিনকাল ৭ ফেব্রুয়ারি ২০০০) চক্ষুমান এক স্থানে লিখেছেন, ‘শাহরিয়ার কবির আর পান্না কায়সারের বক্তব্য থেকে যে বিষয়গুলো পরিষ্কার হয়ে উঠছে, তা হচ্ছে (১) মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্বে অর্থাৎ ১৯৭১-এর ১ ডিসেম্বর থেকে ১৪ ডিসেম্বর যেসব বরেণ্য বুদ্ধিজীবী ঘাতকের হাতে নিহত হয়েছেন তাদের হত্যা রহস্য তদন্তের কাজে ব্যস্ত ছিলেন জহির রায়হান ও লেফটেন্যান্ট সেলিম, (২) তদন্তের কাজ বহুদূর অগ্রসর হয়েছিল এবং তারা এমন কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন, যা প্রকাশ পেলে অনেক রথী-মহারথীর মুখোশ উন্মোচিত হতো, (৩) দু'জনই অজ্ঞাত ব্যক্তির টেলিফোন পেয়ে একত্রে মিরপুর গিয়েছিলেন, সম্ভবত তদন্ত কাজে সহায়ক হবে এমন তথ্যপ্রাপ্তির প্রলোভন দেখানো হয়েছিল, (৪) দু'জনের কেউই আর ফিরে আসেননি; এদিকে বঙ্গভবন থেকেই তদন্তের কাগজপত্র উধাও হয়ে গেছে। এখন প্রশ্ন জাগছে, ১৯৭২ সালে লীগ সরকারের শাসনামলে বঙ্গভবন থেকে জরুরি কাগজপত্র সরিয়ে ফেলার ক্ষমতা কার ছিল? যাদের সম্পর্কে বিপজ্জনক তথ্য উদঘাটিত হয়েছিল, লীগ শাসনামলের সেই রথী-মহারথী কারা হতে পারে? নিশ্চয়ই জ্বিন-ভূতেরা নয়? এখানে একটি বিষয় স্মর্তব্য যে, ১৯৭২-৭৫ এর সরকার ও প্রচার মাধ্যমে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়, রাজাকার-আল বদরদের ওপর চাপিয়ে দেয়া ছাড়া এ ব্যাপারে তেমন কোনো অনুসন্ধানই চালায়নি; জহির রায়হান নিখোঁজ রহস্যও গুরুত্বের সঙ্গে উদঘাটনের তাগিদ কেউ অনুভব করেনি। তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়াচ্ছে? এ প্রসঙ্গে আরেকটু ইতিহাস টানা প্রয়োজন। শহীদুল্লাহ কায়সার, মুনীর চৌধুরী, আনম গোলাম মোস্তফা, শহীদ সাবেরসহ অনেক শহীদ বুদ্ধিজীবী মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করলেও আওয়ামী লীগের অনুসারী ছিলেন না। এরা কমিউনিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। এদের দৃষ্টিতে আওয়ামী লীগ ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের উঠতি পুঁজিপতি শ্রেণীর প্রতিভূ, চূড়ান্ত বিচারে শ্রম শোষক বা শ্রেণীশত্রু। ইসলামীপন্থী দলগুলোর দৃষ্টিতে, আওয়ামী লীগ যেহেতু ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারী, সুতরাং বর্জনীয়। কমিউনিস্ট সংগঠন এবং বাম বুদ্ধিজীবীরা মনে করতেন, ১৯৭১-এর সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ একটি গণতান্ত্রিক বিপ্লব। এটি হচ্ছে, হোক, দেশটাতো স্বাধীন হোক, অতঃপর দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম করতে হবে; আওয়ামী লীগের মতো পেটিবুর্জোয়া সংগঠন দিয়ে সমাজতন্ত্র হবে না। এখানেই ছিল আওয়ামী লীগারদের ভীতি। ষাটের দশকে আ'লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ মাঝে মাঝেই লাঠি, ছুরি নিয়ে চড়াও হতো সমাজতান্ত্রিক আদর্শের ধারক ছাত্র ইউনিয়নের ওপর। মুক্তিযুদ্ধকালেও আওয়ামী লীগের এই ট্রেন্ড প্রকটভাবে ধরা পড়েছে। নড়াইল-ডুমুরিয়া, বরিশালের পেয়ারা বাগান, নরসিংদী বিস্তীর্ণ অঞ্চলসহ যেখানেই বামপন্থীরা নিজস্ব সংগঠন শক্তি বিস্তৃত করে বীর বিক্রমে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, সেখানেই আ'লীগের রিক্রুট করা মুক্তিযোদ্ধারা বাধা দিয়েছে, বাম মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। একই কারণে সাম্যবাদের প্রবক্তা মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে। এখন সবাই উপলব্ধি করছেন, আমাদের স্বাধীনতার জন্য নয় বরং শক্তিমান প্রতিবেশী পাকিস্তানকে ভাঙবার প্রয়োজনেই ভারত মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সহায়তা করেছিল। সে হিসেবে মুক্তিবাহিনী আর মুজিববাহিনী দুইয়ের পেছনেই ছিল ‘র'-এর পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ মদদ। অর্থাৎ এক বৃন্তে দুই ফল। মুক্তিবাহিনী সরাসরি স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করতো। আর মুজিববাহিনী যুদ্ধের পাশাপাশি সমাজতন্ত্রের কথাও বলতো। আর এতেই লীগ নেতাদের রিক্রুট করা মুক্তিযোদ্ধারা মাঝে মাঝেই মুজিব বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তো। সমাজতন্ত্রে যাদের এতো ভীতি, বামচিন্তাকে যারা দেখতেন বিভীষিকার মতো, তারা শহীদুল্লাহ কায়সার, মুনীর চৌধুরীদের মতো বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের প্রীতির চোখে দেখবেন না, সেটাই স্বাভাবিক।

তারপরও ১৯৭২ সালের সদ্য স্বাধীনতার প্রবল আবেগ-উচ্ছবাসের পটভূমিতে রাজাকার আলবদর কর্তৃক বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রচারণাটি বিশ্বাসযোগ্য হয়েছিল। এখন যে সবাই অবিশ্বাস করছেন, তাও নয়। কিন্তু পুরোপুরি বিশ্বাস করার ভিত্তিটা আওয়ামী লীগই নষ্ট করেছে। এর একটি প্রধান কারণ, নিখোঁজ জহির রায়হান সম্পর্কে তৎকালীন লীগ সরকারের আশ্চর্যজনক নির্লিপ্ততা। চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান সাধারণ মানুষ ছিলেন না। কমিউনিস্ট ভাবাদর্শে পরিপুষ্ট এই মানুষটি ছিলেন যেমন প্রতিভাধর, তেমনি একরোখা, সংগ্রামী, ঋজু চরিত্রের। সুতরাং অন্যান্য বামপন্থী শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মতো তিনিও যে লীগ সরকারের পছন্দের ব্যক্তি ছিলেন না, তা বলাই বাহুল্য। তদুপরি এই মানুষটি ভয়ংকর ঝুঁকিপূর্ণ দুটি কাজ করেছিলেন বলে জানা যায়।

প্রথমত, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি ভারত-প্রবাসী লীগ নেতাদের অনেকেরই কু-কীর্তি নাকি সেলুলয়েডে এবং ডায়রীতে বন্দি করে রেখেছিলেন। এ কারণে যেসব লীগ নেতা মুক্তিযুদ্ধের নামে ভারতে গিয়ে পাটের ব্যবসা বা চোরাচালানে ব্যস্ত ছিলেন, যারা মদ আর মেয়ে মানুষ নিয়ে দামী হোটেলে গিয়ে ফূর্তি করেছেন, যারা বেহেড মাতাল হয়ে নর্দমার পাশে পড়ে থেকেছেন বা ভারতীয় পুলিশ কর্তৃক ধৃত হয়েছেন, তারা সবাই জহির রায়হানকে জ্যান্ত-বিভীষিকা জ্ঞান করতেন। কি জানি ওসব কু-কীর্তি যদি তিনি গ্রন্থাগারে লিপিবদ্ধ করেন, কিংবা সেলুলয়েডে বন্দি ছবিগুলো দিয়ে যদি ডকুমেন্টারি কিছু বানিয়ে ফেলেন, কি উপায় হবে? জহির রায়হানের দ্বিতীয় ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি ছিল বুদ্ধিজীবী হত্যার তদন্তে নিয়োজিত হওয়া। এক্ষেত্রেও যে তিনি তৎকালীন রথী-মহারথীদের মুখোশ উন্মোচনের পর্যায়ে গিয়েছিলেন, শাহরিয়ার কবিরের বক্তব্য থেকে তা পরিষ্কার হয়ে গেছে। উল্লেখিত বক্তব্য, মন্তব্য ও প্রাপ্ত তথ্যের সমীকরণ টানলে, এই সত্যই কি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে না যে, জহির রায়হান নিখোঁজ ও হত্যার পশ্চাতে তৎকালীন লীগ সরকারের একটি প্রভাবশালী অংশের কালো হাত সক্রিয় ছিল? আরো কি স্পষ্ট হয়ে ওঠে না যে, বাম বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পশ্চাতেও ওই মহলটির নেপথ্য ভূমিকা ছিল?'

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম