আল্লাহর বিধান পরীক্ষার মাপকাঠি
এখানে এসে প্রত্যেকটি মানুষের মনে এ প্রশ্ন জাগতে পারে যে, কোন্টি আল্লাহর বিধান আর কোন্টি নয়, তা কিরূপে প্রমাণিত হবে? এক একজন এসে বলবে এটা আল্লাহর বিধান, এটা গ্রহণ কর, আর অমনি কি আমরা তা গ্রহণ করবো? যদি তা না হয়, তবে আল্লাহর ব্যবস্থা এবং মানুষের তৈরি ব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য করার কি মানদণ্ড আছে? এ প্রশ্ন প্রত্যেকের মনেই জাগতে পারে, জাগা স্বাভাবিক। আমার নিজের মনেই গভীরভাবে চিন্তা করার সময় এ প্রশ্ন জেগে উঠেছে এ প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে হলে বহু দীর্ঘ ও বিস্তারিত বিশ্লেষণ আবশ্যক। কিন্তু এ ক্ষুদ্র পুস্তিকায় তার অবকাশ নেই। এখানে আমি সংক্ষেপে এর জবাব দিতে চেষ্টা করবো।
মানুষের চিন্তা আর আল্লাহর বুদ্ধির মধ্যে পাথর্ক্য করার জন্য চারটি বড় বড় মাপকাঠি আছে। এখানে তা পর্যায়ক্রমে উল্লেখ করা হয়েছে।
মানুষের চিন্তাধারার প্রথম বৈশিষ্ট্য এই যে, তাতে জ্ঞানের ভ্রান্তি ও সসীমতা অবশ্যম্ভাবীরূপে বর্তমান পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে আল্লাহর ব্যবস্থায় সীমাহীন জ্ঞান এবং সঠিক ও নির্ভুল তত্ত্বের সুস্পষ্ট নিদর্শন স্বতঃস্ফূর্তভাবে পরিলক্ষিত হয়। বস্তুত যে ব্যবস্থা আল্লাহর তরফ হতে হবে তার কোনো কথাই কোনো কালের বৈজ্ঞানিক সত্যের বিরোধী হবে না কিংবা সেই সম্পর্কে কোনো দিনই একথা বলা যাবে না যে, ‘ব্যবস্থাদাতা’ ব্যাপারটির সকল দিক যথাযথভাবে বিচার করে দেখেননি। কিন্তু বিশ্লেষণ ও যাচাই করার এ মানদণ্ড প্রয়োগকালে একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, প্রকৃত জ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক কল্পনা এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে আকাশ পাতালের পার্থক্য রয়েছে। এক যুগে যেসব বৈজ্ঞানিক কল্পনা আর দৃষ্টিভঙ্গি মানুষের মস্তিষ্ককে আচ্ছন্ন করে রাখে, ভুলবশত প্রায়ই সেগুলোকে ‘বিজ্ঞান’ বলে মনে করা হয়। অথচ প্রকৃতপক্ষে সেগুলোর নির্ভুল হওয়ার যতো সম্ভাবনা, ভুল হওয়ারও ঠিক ততোদূরই সম্ভাবনা বর্তমান। মানুষের ধারণা-কল্পনা আর মতবাদ শেষ পর্যন্ত নির্ভুল বিজ্ঞান বলে প্রমাণিত হয়েছে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের ইতিহাসে তার নজীর খুব কমই পাওয়া গেছে।
মানুষের চিন্তা-গবেষণার আর একটি মারাত্মক দূর্বলতা হচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গীর সসীমতা ও সংকীর্ণতা। কিন্তু আল্লাহর ব্যবস্থায় চিন্তা ও দৃষ্টি ব্যাপক এবং সুদুরপ্রসারী হয়ে থাকে। আল্লাহর ব্যবস্থার যে কোনো ধারাকেই আপনি লক্ষ্য করবেন, নিঃসন্দেহে আপনার মনে হবে যে, এর ব্যবস্থাপক আদি হতে অন্ত পর্যন্ত নিজ চোখে প্রত্যক্ষভাবে দেখতে পাচ্ছেন। গোটা সৃষ্টিজগতকে দেখছেন, সমগ্র সত্য আর তত্ত্ব সমবেতভাবে তাঁর সম্মুখে সুস্পষ্টভাবে বিদ্যমান। এর প্রতিকূলে বড় বড় দার্শনিক আর বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে একটি শিশুর চিন্তা বলে প্রতীয়মান হবে। মানুষের চিন্তার তৃতীয় বিশেষত্ব এই যে, তাতে বিজ্ঞান ও বুদ্ধি মানুষের আবেগ-উচ্ছ্বাস ও বাসনা-লালসার সাথে কোথাও না কোথাও সন্ধি বা ষড়যন্ত্র করছে বলে পরিষ্কার মনে হবে। আল্লাহর ব্যবস্থা এটা হতে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত। তাতে স্বচ্ছ জ্ঞান-বুদ্ধি এবং অনাবিল বুদ্ধিমত্তার পরিচয় উজ্জ্বলরূপে দেখতে পাওয়া যায়। তার আদেশ-নির্দেশে কোথাও আবেগ উচ্ছ্বাস ও একদেশদর্শিতার আবিলতা মোটেই পরিলক্ষিত হবে না।
মানুষের চিন্তার আর একটি দুর্বলতা এই যে, যে জীবন ব্যবস্থা সে নিজে রচনা করবে তাতে পক্ষপাতিত্ব, মানুষে মানুষে অবাঞ্ছনীয় বৈষম্য এবং অবৈজ্ঞানিক বুনিয়াদে একজনকে অন্যজনের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দানের ভাবধারা অবশ্যম্ভাবীরূপে বর্তমান পাওয়া যাবে। কারণ প্রত্যেকটি মানুষেরই কিছু না কিছু ব্যক্তিগত স্বার্থ বা কোনো কোনো মানুষের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট ভাবাবেগের দুর্বলতা থাকেই এবং তার ফলেই মানুষ একদেশদর্শী ও পক্ষপাতদুষ্ট ব্যবস্থা রচনা করতে বাধ্য হয়। কিন্তু আল্লাহর ব্যবস্থা এসব কলুষতা হতে সর্বোতভাবে মুক্ত ও পবিত্র।
যেসব জীবন ব্যবস্থা নিজেকে আল্লাহর ব্যবস্থা বা ‘আদ্-দীন’ বলে প্রমাণ করতে সচেষ্ট, তার প্রত্যেকটিকেই এ মানদণ্ডে যাচাই করে দেখতে হবে। যদি তা মানবীয় চিন্তা গবেষণার উল্লিখিত বিশেষত্ব হতে মুক্ত হয় তবে তাকে ‘আদ্-দীন’ বা মানুষের পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা বলে বিশ্বাস করতে কোনোই আপত্তি থাকতে পারে না।
মানুষের চিন্তা আর আল্লাহর বুদ্ধির মধ্যে পাথর্ক্য করার জন্য চারটি বড় বড় মাপকাঠি আছে। এখানে তা পর্যায়ক্রমে উল্লেখ করা হয়েছে।
মানুষের চিন্তাধারার প্রথম বৈশিষ্ট্য এই যে, তাতে জ্ঞানের ভ্রান্তি ও সসীমতা অবশ্যম্ভাবীরূপে বর্তমান পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে আল্লাহর ব্যবস্থায় সীমাহীন জ্ঞান এবং সঠিক ও নির্ভুল তত্ত্বের সুস্পষ্ট নিদর্শন স্বতঃস্ফূর্তভাবে পরিলক্ষিত হয়। বস্তুত যে ব্যবস্থা আল্লাহর তরফ হতে হবে তার কোনো কথাই কোনো কালের বৈজ্ঞানিক সত্যের বিরোধী হবে না কিংবা সেই সম্পর্কে কোনো দিনই একথা বলা যাবে না যে, ‘ব্যবস্থাদাতা’ ব্যাপারটির সকল দিক যথাযথভাবে বিচার করে দেখেননি। কিন্তু বিশ্লেষণ ও যাচাই করার এ মানদণ্ড প্রয়োগকালে একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, প্রকৃত জ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক কল্পনা এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে আকাশ পাতালের পার্থক্য রয়েছে। এক যুগে যেসব বৈজ্ঞানিক কল্পনা আর দৃষ্টিভঙ্গি মানুষের মস্তিষ্ককে আচ্ছন্ন করে রাখে, ভুলবশত প্রায়ই সেগুলোকে ‘বিজ্ঞান’ বলে মনে করা হয়। অথচ প্রকৃতপক্ষে সেগুলোর নির্ভুল হওয়ার যতো সম্ভাবনা, ভুল হওয়ারও ঠিক ততোদূরই সম্ভাবনা বর্তমান। মানুষের ধারণা-কল্পনা আর মতবাদ শেষ পর্যন্ত নির্ভুল বিজ্ঞান বলে প্রমাণিত হয়েছে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের ইতিহাসে তার নজীর খুব কমই পাওয়া গেছে।
মানুষের চিন্তা-গবেষণার আর একটি মারাত্মক দূর্বলতা হচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গীর সসীমতা ও সংকীর্ণতা। কিন্তু আল্লাহর ব্যবস্থায় চিন্তা ও দৃষ্টি ব্যাপক এবং সুদুরপ্রসারী হয়ে থাকে। আল্লাহর ব্যবস্থার যে কোনো ধারাকেই আপনি লক্ষ্য করবেন, নিঃসন্দেহে আপনার মনে হবে যে, এর ব্যবস্থাপক আদি হতে অন্ত পর্যন্ত নিজ চোখে প্রত্যক্ষভাবে দেখতে পাচ্ছেন। গোটা সৃষ্টিজগতকে দেখছেন, সমগ্র সত্য আর তত্ত্ব সমবেতভাবে তাঁর সম্মুখে সুস্পষ্টভাবে বিদ্যমান। এর প্রতিকূলে বড় বড় দার্শনিক আর বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে একটি শিশুর চিন্তা বলে প্রতীয়মান হবে। মানুষের চিন্তার তৃতীয় বিশেষত্ব এই যে, তাতে বিজ্ঞান ও বুদ্ধি মানুষের আবেগ-উচ্ছ্বাস ও বাসনা-লালসার সাথে কোথাও না কোথাও সন্ধি বা ষড়যন্ত্র করছে বলে পরিষ্কার মনে হবে। আল্লাহর ব্যবস্থা এটা হতে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত। তাতে স্বচ্ছ জ্ঞান-বুদ্ধি এবং অনাবিল বুদ্ধিমত্তার পরিচয় উজ্জ্বলরূপে দেখতে পাওয়া যায়। তার আদেশ-নির্দেশে কোথাও আবেগ উচ্ছ্বাস ও একদেশদর্শিতার আবিলতা মোটেই পরিলক্ষিত হবে না।
মানুষের চিন্তার আর একটি দুর্বলতা এই যে, যে জীবন ব্যবস্থা সে নিজে রচনা করবে তাতে পক্ষপাতিত্ব, মানুষে মানুষে অবাঞ্ছনীয় বৈষম্য এবং অবৈজ্ঞানিক বুনিয়াদে একজনকে অন্যজনের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দানের ভাবধারা অবশ্যম্ভাবীরূপে বর্তমান পাওয়া যাবে। কারণ প্রত্যেকটি মানুষেরই কিছু না কিছু ব্যক্তিগত স্বার্থ বা কোনো কোনো মানুষের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট ভাবাবেগের দুর্বলতা থাকেই এবং তার ফলেই মানুষ একদেশদর্শী ও পক্ষপাতদুষ্ট ব্যবস্থা রচনা করতে বাধ্য হয়। কিন্তু আল্লাহর ব্যবস্থা এসব কলুষতা হতে সর্বোতভাবে মুক্ত ও পবিত্র।
যেসব জীবন ব্যবস্থা নিজেকে আল্লাহর ব্যবস্থা বা ‘আদ্-দীন’ বলে প্রমাণ করতে সচেষ্ট, তার প্রত্যেকটিকেই এ মানদণ্ডে যাচাই করে দেখতে হবে। যদি তা মানবীয় চিন্তা গবেষণার উল্লিখিত বিশেষত্ব হতে মুক্ত হয় তবে তাকে ‘আদ্-দীন’ বা মানুষের পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা বলে বিশ্বাস করতে কোনোই আপত্তি থাকতে পারে না।
ঈমানের দাবি
এখন প্রশ্ন এই যে, কুরআনের এই দাবি মানলে এবং যে জীবন বিধান আল্লাহর তরফ হতে নাযিল হয়েছে বলে বিশ্বাস হবে তাকে গ্রহণ করলে, মানুষের প্রতি কি কতর্ব্য আবর্তিত হয়? উপসংহারে এ প্রশ্ন সম্পর্কেই আলোচনা করতে চাই।
পূর্বেই বলা হয়েছে যে, ইসলামের অর্থ নত হওয়া, আত্মসমর্পণ করা এবং নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সোপর্দ করে দেয়া। এ নতি স্বীকার ও আত্মসমর্পণের সাথে আত্মম্ভরিতা এবং চিন্তা ও কর্মের নিরংকুশ আযাদীর কোনো সামঞ্জস্য হতে পারে না। যে জীবন ব্যবস্থার প্রতিই মানুষ বিশ্বাস স্থাপন করবে, তার নিকট তার সমগ্র ব্যক্তি সত্তাকে সম্পূর্ণরূপে সোপর্দ করে দিতে হবে। জীবনের কোনো ; একটি ব্যাপারকেও তার বাইরে রাখতে পারবে না। ঈমানের অর্থ এই যে, ‘দীন’ বা জীবন ব্যবস্থাই মানুষের মন ও মস্তিষ্কের উপর পূর্ণ আধিপত্য বিস্তার করে থাকবে ; এটাই হবে তার চোখ ও কানের ধর্ম, হাত ও পায়ের ধর্ম, পেট ও দেহের ধর্ম, তার কলম ও মুখের ধর্ম, তার আজীবনের চেষ্টা-সাধনা ও কর্মের ধর্ম, ভালবাসা ও ঘৃণার ধর্ম, তার বন্ধুত্ব আর শত্রুতার ধর্ম। মোটকথা মানুষের ব্যক্তি সত্তার কোনো একটি দিক ও বিভাগই এহেন ধর্মের বাইরে থাকতে পারবে না। জীবনের যে কাজ বা দিকই এক দীন বা জীবন ব্যবস্থার প্রভাবমুক্ত হবে এবং যে কাজে বা জীবনের যে দিকেই এ জীবন ব্যবস্থার অনুসরণ পরিত্যক্ত হবে তার প্রতি ঈমানের দাবিতে ততোই মিথ্যা ও প্রতারণার যোগ থাকবে, এতে কিছু মাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। আর জীবনকে মিথ্যা ও প্রতারণার কলুষ হতে মুক্ত রাখা প্রত্যেক বুদ্ধিমান ও সত্যসিদ্ধ মানুষের পক্ষে অবশ্যই কতর্ব্য।
এ পুস্তকের প্রথমদিকে একথাও বলা হয়েছে যে, মানুষের জীবন একটি সামগ্রিক ও অভিন্ন সত্তা ; তাকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করা যায় না। কাজেই মানুষের পূর্ণ জীবনের জন্য একটি মাত্র ধর্ম বা জীবন ব্যবস্থাই হতে পারে। একই সময় একাধিক জীবন ব্যবস্থা অনুসরণ করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। কেননা তা করতে গেলে ঈমানের অনিশ্চিত অবস্থা, মতের বিশিষ্টতা ও অসংবদ্ধতা এবং জটিল ব্যাপার সম্বন্ধে স্থির-সিদ্ধান্ত গ্রহণে অক্ষমতাই প্রমাণ হবে। বস্তুত ‘কোনো আদর্শকে’ যখন মানুষ ‘আদ্-দীন’ বা জীবন ব্যবস্থা হিসাবে গ্রহণ করে এবং তার জীবন ব্যবস্থা হওয়া সম্পর্কে স্থির সিদ্ধান্ত করে তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা হয়, তখন তা তার পূর্ণ জীবনকে সকল দিক ও বিভাগের ‘একমাত্র ব্যবস্থা’ হওয়া চাই এবং বাধ্য হওয়াই তাকে এভাবেই গ্রহণ করতে হবে, তাছাড়া গত্যন্তর নেই।
তাকে যদি ব্যক্তিগত ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করা হয়, তবে তা ঘরের ব্যবস্থা হবে, শিশু শিক্ষার ব্যবস্থা হবে, তার শিক্ষা-দীক্ষা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থা হবে, তার কায় -কারবার, ব্যবসায়-বাণিজ্য ও আয়-উপার্জনের, তার ঘরোয়া জীবন এবং জাতীয় কর্মনীতির, তার রাজনীতি ও তামাদ্দুনের, তার সাহিত্য ও শিল্পের ব্যবস্থা হবে, বস্তুত এরূপ না হওয়ার কোনোই কারণ থাকতে পারে না যে, একটা মুক্তাকে যখন আরো অনেক মুক্তার সাথে একই সূত্রে গেথে দেয়া হবে, তখন আর তা মুক্তা থাকবে না। তখন তা ছোলা বুট হয়ে যাবে, এমন কোনো কথাই হতে পারে না। অনুরূপভাবে একথাও যদি আমি বুঝতে পারি না যে, ব্যক্তিগতভাবে তো আমরা একটি ব্যবস্থা অনুসরণ করবো কিন্তু যখন আমাদের একাধিক লোকের জীবনকে সংঘবদ্ধ করবো তখন সেই সংঘবদ্ধ ও সমাজবদ্ধ জীবনের কোনো কোনো দিক সেই ব্যবস্থার আওতার বাইরে থাকবে। এ ধরনের কথার অন্তসারশূন্যতা সুস্পষ্ট।
ঈমান সম্পর্কে সর্বাপেক্ষা বড় কথা এই যে, কোনো ব্যবস্থাকে যখন জীবন ব্যবস্থা হিসাবে বিশ্বাস ও গ্রহণ করা হয়, তখন সমগ্র জাতিকে তার কল্যাণ ও সৌন্দর্য গ্রহণ করার সুযোগ দেয়া অবশ্য কর্তব্য এবং তাকে সমগ্র দুনিয়ার ব্যবস্থা হিসাবে প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করা বাঞ্ছনীয়। সত্য যেমন স্বভাবতই সর্বজয়ী হতে চায় তেমনি সত্য প্রেমিকও সত্যকে বাতিলের উপর জয়ী করার জন্য চেষ্টা না করে থাকতে পারে না। যে ব্যক্তি প্রত্যক্ষভাবে দেখবে যে, বাতিল চারদিক হতে পৃথিবী এবং পৃথিবীর অধিবাসীগণকে গ্রাস করছে তখন এ দৃশ্য দেখে তার মধ্যে যদি কোনোরূপ ব্যস্ততা ব্যাকুলতা, ব্যাথা এবং অস্থিরতা জেগে না উঠে তবে মনে করতে হবে যে, সত্যের জন্য তার মনে প্রকৃতই কোনো দরদ নেই, সত্যিকার কোনো প্রেম নেই। আর তা থাকলেও একেবারে অচেতন ও গভীর নিন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। কিন্তু চেতনা ও অনুভূতির এ নিদ্রা পরিণামে কাল-নিদ্রায় পরিণত না হয়, সময় থাকতেই সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বন করা বাঞ্ছনীয়।
পূর্বেই বলা হয়েছে যে, ইসলামের অর্থ নত হওয়া, আত্মসমর্পণ করা এবং নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সোপর্দ করে দেয়া। এ নতি স্বীকার ও আত্মসমর্পণের সাথে আত্মম্ভরিতা এবং চিন্তা ও কর্মের নিরংকুশ আযাদীর কোনো সামঞ্জস্য হতে পারে না। যে জীবন ব্যবস্থার প্রতিই মানুষ বিশ্বাস স্থাপন করবে, তার নিকট তার সমগ্র ব্যক্তি সত্তাকে সম্পূর্ণরূপে সোপর্দ করে দিতে হবে। জীবনের কোনো ; একটি ব্যাপারকেও তার বাইরে রাখতে পারবে না। ঈমানের অর্থ এই যে, ‘দীন’ বা জীবন ব্যবস্থাই মানুষের মন ও মস্তিষ্কের উপর পূর্ণ আধিপত্য বিস্তার করে থাকবে ; এটাই হবে তার চোখ ও কানের ধর্ম, হাত ও পায়ের ধর্ম, পেট ও দেহের ধর্ম, তার কলম ও মুখের ধর্ম, তার আজীবনের চেষ্টা-সাধনা ও কর্মের ধর্ম, ভালবাসা ও ঘৃণার ধর্ম, তার বন্ধুত্ব আর শত্রুতার ধর্ম। মোটকথা মানুষের ব্যক্তি সত্তার কোনো একটি দিক ও বিভাগই এহেন ধর্মের বাইরে থাকতে পারবে না। জীবনের যে কাজ বা দিকই এক দীন বা জীবন ব্যবস্থার প্রভাবমুক্ত হবে এবং যে কাজে বা জীবনের যে দিকেই এ জীবন ব্যবস্থার অনুসরণ পরিত্যক্ত হবে তার প্রতি ঈমানের দাবিতে ততোই মিথ্যা ও প্রতারণার যোগ থাকবে, এতে কিছু মাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। আর জীবনকে মিথ্যা ও প্রতারণার কলুষ হতে মুক্ত রাখা প্রত্যেক বুদ্ধিমান ও সত্যসিদ্ধ মানুষের পক্ষে অবশ্যই কতর্ব্য।
এ পুস্তকের প্রথমদিকে একথাও বলা হয়েছে যে, মানুষের জীবন একটি সামগ্রিক ও অভিন্ন সত্তা ; তাকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করা যায় না। কাজেই মানুষের পূর্ণ জীবনের জন্য একটি মাত্র ধর্ম বা জীবন ব্যবস্থাই হতে পারে। একই সময় একাধিক জীবন ব্যবস্থা অনুসরণ করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। কেননা তা করতে গেলে ঈমানের অনিশ্চিত অবস্থা, মতের বিশিষ্টতা ও অসংবদ্ধতা এবং জটিল ব্যাপার সম্বন্ধে স্থির-সিদ্ধান্ত গ্রহণে অক্ষমতাই প্রমাণ হবে। বস্তুত ‘কোনো আদর্শকে’ যখন মানুষ ‘আদ্-দীন’ বা জীবন ব্যবস্থা হিসাবে গ্রহণ করে এবং তার জীবন ব্যবস্থা হওয়া সম্পর্কে স্থির সিদ্ধান্ত করে তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা হয়, তখন তা তার পূর্ণ জীবনকে সকল দিক ও বিভাগের ‘একমাত্র ব্যবস্থা’ হওয়া চাই এবং বাধ্য হওয়াই তাকে এভাবেই গ্রহণ করতে হবে, তাছাড়া গত্যন্তর নেই।
তাকে যদি ব্যক্তিগত ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করা হয়, তবে তা ঘরের ব্যবস্থা হবে, শিশু শিক্ষার ব্যবস্থা হবে, তার শিক্ষা-দীক্ষা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থা হবে, তার কায় -কারবার, ব্যবসায়-বাণিজ্য ও আয়-উপার্জনের, তার ঘরোয়া জীবন এবং জাতীয় কর্মনীতির, তার রাজনীতি ও তামাদ্দুনের, তার সাহিত্য ও শিল্পের ব্যবস্থা হবে, বস্তুত এরূপ না হওয়ার কোনোই কারণ থাকতে পারে না যে, একটা মুক্তাকে যখন আরো অনেক মুক্তার সাথে একই সূত্রে গেথে দেয়া হবে, তখন আর তা মুক্তা থাকবে না। তখন তা ছোলা বুট হয়ে যাবে, এমন কোনো কথাই হতে পারে না। অনুরূপভাবে একথাও যদি আমি বুঝতে পারি না যে, ব্যক্তিগতভাবে তো আমরা একটি ব্যবস্থা অনুসরণ করবো কিন্তু যখন আমাদের একাধিক লোকের জীবনকে সংঘবদ্ধ করবো তখন সেই সংঘবদ্ধ ও সমাজবদ্ধ জীবনের কোনো কোনো দিক সেই ব্যবস্থার আওতার বাইরে থাকবে। এ ধরনের কথার অন্তসারশূন্যতা সুস্পষ্ট।
ঈমান সম্পর্কে সর্বাপেক্ষা বড় কথা এই যে, কোনো ব্যবস্থাকে যখন জীবন ব্যবস্থা হিসাবে বিশ্বাস ও গ্রহণ করা হয়, তখন সমগ্র জাতিকে তার কল্যাণ ও সৌন্দর্য গ্রহণ করার সুযোগ দেয়া অবশ্য কর্তব্য এবং তাকে সমগ্র দুনিয়ার ব্যবস্থা হিসাবে প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করা বাঞ্ছনীয়। সত্য যেমন স্বভাবতই সর্বজয়ী হতে চায় তেমনি সত্য প্রেমিকও সত্যকে বাতিলের উপর জয়ী করার জন্য চেষ্টা না করে থাকতে পারে না। যে ব্যক্তি প্রত্যক্ষভাবে দেখবে যে, বাতিল চারদিক হতে পৃথিবী এবং পৃথিবীর অধিবাসীগণকে গ্রাস করছে তখন এ দৃশ্য দেখে তার মধ্যে যদি কোনোরূপ ব্যস্ততা ব্যাকুলতা, ব্যাথা এবং অস্থিরতা জেগে না উঠে তবে মনে করতে হবে যে, সত্যের জন্য তার মনে প্রকৃতই কোনো দরদ নেই, সত্যিকার কোনো প্রেম নেই। আর তা থাকলেও একেবারে অচেতন ও গভীর নিন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। কিন্তু চেতনা ও অনুভূতির এ নিদ্রা পরিণামে কাল-নিদ্রায় পরিণত না হয়, সময় থাকতেই সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বন করা বাঞ্ছনীয়।
0 comments: