‘আদ্-দীন’ এর পরিচয়
মানুষের জন্য যে ‘আদ্-দীন’ বা একমাত্র জীবন ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা এই মাত্র প্রমাণ করলাম, তা কোনো বিস্তারিত বিধান নয়, তাতে সর্বকালের সমগ্র ছোট-বড় ও খুঁটিনাটি বিষয়ের নির্দেশ বর্তমান থাকার কোনোই আবশ্যকতা নেই। বরং প্রকৃতপক্ষে এ একমাত্র জীবন ব্যবস্থার অর্থ এমন একটি সর্বব্যাপক চিরন্তনী ও মৌলিক বিধান যা সর্বাবস্থায় মানুষের পথনির্দেশ করতে পারে যা মানুষের চিন্তা ও গবেষণা, চেষ্টা সাধনা এবং সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার সঠিক দিক নির্ণয় করতে পারে এবং তাকে ভুল অভিজ্ঞতা অর্জনে সময়, শ্রম, শক্তি ব্যয় হতে রক্ষা করতে পারে। এজন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন এই যে, মানুষ নিশ্চিতরূপে জেনে নিবে নিছক আন্দাজ অনুমান দ্বারা নয়, বরং নিশ্চিত জ্ঞানের সাহায্যে জেনে নিবে যে, তার এবং এ বিশ্বপ্রকৃতির নিগূঢ় তত্ত্ব কি? এবং এ বিশাল বিশ্বে তার অবস্থান কোথায়? তারপর তাকে জানতে হবে কেবল বুঝে নিলেই চলবে না, খুব ভালো করেই জেনে নিতে হবে যে, এ দুনিয়ার জীবনই কি একমাত্র জীবন, না এটা সমগ্র জীবনের একটি প্রাথমিক অধ্যায় মাত্র? মানুষের এ অবিশ্রান্ত যাত্রা কি শুধু জন্ম হতে মৃত্যু পর্যন্ত সীমাবদ্ধ, না ইহজীবন এক সীমাহীন দীর্ঘ সফরের এক অধ্যায় মাত্র? অতপর তাকে অবশ্যম্ভাবীরূপে জীবনের একটি উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে এমন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, যা প্রকৃতপক্ষেই মানব জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য হতে পারে, যার জন্য মূলত মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে। সে উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য এমন হওয়া বাঞ্ছনীয়, যা প্রত্যেকটি ব্যক্তি প্রত্যেকটি দল এবং সমষ্টিগতভাবে সমগ্র মানবতা সকল কালেই, কোনো দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ ব্যতিরেকেই, নিজ নিজ উদ্দেশ্যরূপে গ্রহণ করতে পারে।
এরপর মানুষের নৈতিক চরিত্রের জন্য এমন এক সুদৃঢ় ও সামগ্রিক নিয়ম পদ্ধতি আবশ্যক, যা প্রকৃতির সমগ্র বৈশিষ্ট্যের সাথে সামঞ্জস্য স্থাপন করতে পারে এবং সমগ্র সম্ভাব্য অবস্থার উপর কাল্পনিক ও বাস্তব ক্ষেত্রে খাপ খেতে পারে। কারণ এরূপ হলেই সে এ নিয়ম পদ্ধতির ভিত্তিতে নিজের স্বভাব চরিত্র গঠন করতে পারবে, সে নিয়ম পদ্ধতি পথনির্দেশ জীবন পথের প্রত্যেক মঞ্জিলে তৎসংক্রান্ত যাবতীয় অবস্থা ও সমস্যাবলীর সুষ্ঠু সমাধান করতে পারবে। ফলে বিবর্তনশীল অবস্থা ও নিত্যঘটিত সমস্যাবলীর সাথে সাথে নতুন নতুন চরিত্রনীতি রচনার আবশ্যক হবে না, অন্য কথায় নীতিহীন ও সুবিধাবাদী (characterless and opportunist) হয়ে জীবন যাপন করতে সে বাধ্য হবে না।
তারপর মানুষের জন্য এমন পূর্ণাংগ ও ব্যাপক তামাদ্দুনিক নীতি আবশ্যক, যা মানব সমাজের মূলনীতি ও উদ্দেশ্য এবং তার সহজাত বৃত্তির প্রতি লক্ষ্য রেখে বিরচিত হবে। তাতে অতিরিক্ত গোঁড়ামী কিংবা শৈথিল্য এবং অসংগত কার্যক্রমের কোনো অবকাশ থাকবে না। তাতে সমগ্র মানুষের সামগ্রিক স্বার্থ এবং সুবিধার প্রতি অবশ্যই দৃষ্টি থাকবে। তা অনুসরণ করে যেন প্রত্যেক যুগে মানব জীবনের প্রত্যেক দিকের বাস্তব রূপায়ন, পূণর্গঠন এবং উৎকর্ষ সাধনের জন্য চেষ্টা ও সাধনা করা সম্ভব হয়।
মানুষের ব্যক্তিগত আচরণ, সামাজিক কার্যক্রম এবং চেষ্টা ও সাধনাকে বিশুদ্ধ ও নির্ভুল পথে পরিচালনা এবং ভ্রান্ত পথের মারাত্মক পরিণতি হতে রক্ষা করার জন্য একটা নির্দিষ্ট সীমারেখা থাকা আবশ্যক, যা জীবনের বিশাল রাজপথে পথ চিহ্নরূপে প্রত্যেক মোড়ে, প্রত্যেক চৌমাথায় এবং সংকট ক্ষেত্রে তাকে সজাগ ও সচেতন করে দিবে এবং বলতে পারবে যে, তোমার পথ ঐদিকে নয়, এদিকে।
মানুষের জন্য কতকগুলো সুস্পষ্ট কর্মনীতিও আবশ্যক যা সে সার্বজনীন চিরস্থায়ী পন্থা হিসাবে অনুসরণ করতে পারবে এবং যা এ ‘আদ্-দীন’ নির্ধারিত জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, নৈতিক আদর্শ, সামাজিক ও তামাদ্দুনিক নীতি এবং কর্মসীমার সাথে মানুষের জীবনকে যুক্ত করে রাখতে পারবে।
এ ধরণের জীবন পদ্ধতি রচনা করার প্রশ্ন মানুষের সম্মুখে উপস্থিত। এখন বিশেষভাবে চিন্তা করতে হতো যে, এ ধরনের কোনো ‘আদ্-দীন’ বা জীবন বিধান রচনা করার মতো যোগ্যতা, ক্ষমতা বা উপায় উপাদান সত্যই মানুষের আয়ত্তাধীন আছে কি?
এরপর মানুষের নৈতিক চরিত্রের জন্য এমন এক সুদৃঢ় ও সামগ্রিক নিয়ম পদ্ধতি আবশ্যক, যা প্রকৃতির সমগ্র বৈশিষ্ট্যের সাথে সামঞ্জস্য স্থাপন করতে পারে এবং সমগ্র সম্ভাব্য অবস্থার উপর কাল্পনিক ও বাস্তব ক্ষেত্রে খাপ খেতে পারে। কারণ এরূপ হলেই সে এ নিয়ম পদ্ধতির ভিত্তিতে নিজের স্বভাব চরিত্র গঠন করতে পারবে, সে নিয়ম পদ্ধতি পথনির্দেশ জীবন পথের প্রত্যেক মঞ্জিলে তৎসংক্রান্ত যাবতীয় অবস্থা ও সমস্যাবলীর সুষ্ঠু সমাধান করতে পারবে। ফলে বিবর্তনশীল অবস্থা ও নিত্যঘটিত সমস্যাবলীর সাথে সাথে নতুন নতুন চরিত্রনীতি রচনার আবশ্যক হবে না, অন্য কথায় নীতিহীন ও সুবিধাবাদী (characterless and opportunist) হয়ে জীবন যাপন করতে সে বাধ্য হবে না।
তারপর মানুষের জন্য এমন পূর্ণাংগ ও ব্যাপক তামাদ্দুনিক নীতি আবশ্যক, যা মানব সমাজের মূলনীতি ও উদ্দেশ্য এবং তার সহজাত বৃত্তির প্রতি লক্ষ্য রেখে বিরচিত হবে। তাতে অতিরিক্ত গোঁড়ামী কিংবা শৈথিল্য এবং অসংগত কার্যক্রমের কোনো অবকাশ থাকবে না। তাতে সমগ্র মানুষের সামগ্রিক স্বার্থ এবং সুবিধার প্রতি অবশ্যই দৃষ্টি থাকবে। তা অনুসরণ করে যেন প্রত্যেক যুগে মানব জীবনের প্রত্যেক দিকের বাস্তব রূপায়ন, পূণর্গঠন এবং উৎকর্ষ সাধনের জন্য চেষ্টা ও সাধনা করা সম্ভব হয়।
মানুষের ব্যক্তিগত আচরণ, সামাজিক কার্যক্রম এবং চেষ্টা ও সাধনাকে বিশুদ্ধ ও নির্ভুল পথে পরিচালনা এবং ভ্রান্ত পথের মারাত্মক পরিণতি হতে রক্ষা করার জন্য একটা নির্দিষ্ট সীমারেখা থাকা আবশ্যক, যা জীবনের বিশাল রাজপথে পথ চিহ্নরূপে প্রত্যেক মোড়ে, প্রত্যেক চৌমাথায় এবং সংকট ক্ষেত্রে তাকে সজাগ ও সচেতন করে দিবে এবং বলতে পারবে যে, তোমার পথ ঐদিকে নয়, এদিকে।
মানুষের জন্য কতকগুলো সুস্পষ্ট কর্মনীতিও আবশ্যক যা সে সার্বজনীন চিরস্থায়ী পন্থা হিসাবে অনুসরণ করতে পারবে এবং যা এ ‘আদ্-দীন’ নির্ধারিত জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, নৈতিক আদর্শ, সামাজিক ও তামাদ্দুনিক নীতি এবং কর্মসীমার সাথে মানুষের জীবনকে যুক্ত করে রাখতে পারবে।
এ ধরণের জীবন পদ্ধতি রচনা করার প্রশ্ন মানুষের সম্মুখে উপস্থিত। এখন বিশেষভাবে চিন্তা করতে হতো যে, এ ধরনের কোনো ‘আদ্-দীন’ বা জীবন বিধান রচনা করার মতো যোগ্যতা, ক্ষমতা বা উপায় উপাদান সত্যই মানুষের আয়ত্তাধীন আছে কি?
মানুষের উপায় উপাদানের বিশ্লেষণ
মানুষের জন্য ‘দীন’ বা জীবন ব্যবস্থা রচনা করার মাত্র চারটি উপায় ও পন্থা মানুষের আয়ত্তাধীন রয়েছে। প্রথম উপায় হচ্ছে, মানুষের ইচ্ছাশক্তি, দ্বিতীয় মানুষের বুদ্ধি, তৃতীয় প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ ও বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং চতুর্থ হচ্ছে অতীত অভিজ্ঞতাসমূহের ঐতিহাসিক সম্পদ। এ চারটি উপায় ছাড়া কোনো পঞ্চম উপায় নির্ধারণ করা প্রায় অসম্ভব। এ চারটি উপায়ের যতোদূর যাচাই ও পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব হতে পারে, তা আপনি পরীক্ষা করে দেখুন এবং বিচার করে দেখুন, এসব উপায়ের সাহায্যে মানুষের জন্য ‘আদ্-দীন’ বা একমাত্র জীবন ব্যবস্থা রচনা করা কি কোনো প্রকারেই সম্ভব হতে পারে? ব্যক্তিগতভাবে আমি আমার জীবনের একটি বিরাট অংশ এসব বিষয়ের তত্ত্বানুসন্ধানে ও যাচাই পরীক্ষার কাজে অতিবাহিত করেছি এবং সর্বশেষে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, এ উপায়গুলো মানুষের জীবন ব্যবস্থা রচনায় কিছুমাত্র সহায়তা করতে পারে না। অবশ্য কোনো মানবাতীত সত্তা পথপ্রদর্শক হয়ে যদি মানুষের সম্মুখে কোনো জীবন ব্যবস্থা উপস্থিত করে তবে তা বুঝতে, হৃদয়ংগম করতে, পরীক্ষা ও যাচাই করতে এবং তদনুযায়ী জীবনের বিস্তারিত বিধান সময় ও কর্মোপযোগী করে রচনা করতে এসব মানবীয় উপায় অবশ্যই কিছু না কিছু করতে পারে। কিন্তু মানুষের জন্য প্রয়োজন ‘আদ্-দীন’ বা পূর্ণ জীবন ব্যবস্থা রচনার জন্য এসবের কোনো ক্ষমতাই নেই।
ইচ্ছাশক্তি
প্রথমে মানুষের ইচ্ছাশক্তি সম্পর্কে আলোচনা করে দেখা যাক। প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কি মানুষের পথপ্রদর্শক হতে পারে? এ শক্তিটি যদিও মানুষের প্রেরণা লাভের প্রকৃত উৎস উদ্বোধক, কিন্তু তা সত্ত্বেও এর মূল প্রকৃতিতে যেসব দূর্বলতা বিদ্যামন রয়েছে, তার কারণে এটা কিছুতেই মানুষের পথ প্রদর্শন করার যোগ্য হতে পারে না। শুধু পথ প্রদর্শন করাতো দূরের কথা, মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধিকে পর্যন্ত অনেক বিভ্রান্ত করে থাকে। নানাবিধ শিক্ষা-দীক্ষা ও ট্রেনিং দেয়ার পর এ শক্তিকে যতোদূরই আধুনিক, তেজস্বী ও জ্যোতিষ্মান করে তোলা হোক না কেন, কোনো গুরুতর ব্যাপার শেষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার দায়িত্ব এর উপর যখনই ন্যস্ত করা হবে, তখনি এটা শতকরা অন্তত নিরানব্বইটি অবস্থায় ভ্রান্তিপূর্ণ ফায়সালা দিবে, তাতে সন্দেহ নেই। কারণ এর অভ্যন্তরে যেসব ভাবধারা বর্তমান পাওয়া যায়, তা তাকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সাহায্য করে না, বরং বঞ্চিতকে কোনো না কোনো প্রকারে অবিলম্বে লাভ করার জন্য অনুকূল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বাধ্য করে। এটা মানুষের ইচ্ছাশক্তির স্বাভাবিক দুর্বলতা বিশেষ। কাজেই এ শক্তি একজন ব্যক্তিরই হোক কিংবা বিশেষ কোনো শ্রেণীর হোক অথবা রুশোর কথা অনুযায়ী সার্বজনীন ইচ্ছাশক্তি (general will) হোক না কেন, মানুষের জন্য কোনো পূর্ণ জীবন ব্যবস্থা রচনার উপযোগী যোগ্যতা স্বভাবতই কোনো ইচ্ছাশক্তির নেই। অধিকন্তু মানুষের ইচ্ছাশক্তি মানব জীবনের নিগূঢ় তত্ত্ব, তার লক্ষ্য, গতি ও পরিণতি সম্পর্কীয় উচ্চতর সমস্যাগুলোর (utimate problems) কোনো সমাধানই দান করতে পারে না।
বুদ্ধি
এখন মানুষের বুদ্ধি সম্পর্কে আলোচনা করে দেখা যাক। বুদ্ধির ক্ষমতা অসাধারণ, তার যোগ্যতা ও প্রতিভা অনস্বীকার্য। মানব জীবনে তার গুরুত্ব এবং মর্যাদাও কেউ উপেক্ষা করতে পারে না। পরন্তু মানুষের অভ্যন্তরে এটা অত্যন্ত তীব্র প্রেরণাদায়ক শক্তি, তাও স্বীকার না করে উপায় নেই ; কিন্তু সমস্যা এই যে, মানুষের জন্য জীবন ব্যবস্থা রচনা করার দায়িত্ব তার উপর ন্যস্ত করা হলে তা করবে কার বুদ্ধি? জায়েদের বুদ্ধি না বকরের বুদ্ধি? না সমগ্র মানুষের বুদ্ধি ? না মানুষের বিশেষ কোনো দল বা শ্রেণীর বুদ্ধি? বর্তমান যুগের মানুষের বুদ্ধি? না অতীত কোনো যুগের মানুষের বুদ্ধি? কি অনাগত যুগের মানুষের বুদ্ধি? আর এ প্রশ্ন না হয় না-ই করলাম, কারণ এর সঠিক জবাব দেয়া সম্ভব নয়। এ প্রসংগে সহজ একটি প্রশ্নই জিজ্ঞেস করতে চাই। মানব বুদ্ধির চৌহদ্দি পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করে দেখলে মানুষের জীবন ব্যবস্থা রচনা করার মতো বিরাট ও জটিল কাজ তার উপর ন্যস্ত করা কি কোনো রকমেই শোভা পায়?
বস্তুত কোনো কিছু সম্পর্কে বুদ্ধির সিদ্ধান্ত গ্রহণ একান্তরূপে নির্ভর করে পঞ্চইন্দ্রিয় কর্তৃক সংগৃহীত তথ্যের উপর। এটা ভুল তথ্য সংগ্রহ করলে বুদ্ধি ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বাধ্য। তা অসম্পূর্ণ তথ্য উপস্থিত করলে বুদ্ধির সিদ্ধান্ত অসম্পূর্ণই হবে এবং যেসব ব্যাপারে ইন্দ্রিয় কোনো তথ্যই সংগ্রহ করতে পারবে না, বুদ্ধির আত্মজ্ঞান থাকলে সেসব ব্যাপারে তা কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করারই দুঃসাহস করবে না। আর তা অন্ধ ও দাম্ভিক হলে অন্ধকারে কাষ্ঠ নির্মিত তীর নিক্ষেপ করে অবশ্যই ব্যর্থ হবে। যে বুদ্ধির পরিধি এতো সীমাবদ্ধ ও সংকীর্ণ, মানব জাতির জন্য এক পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা রচনা করার দায়িত্ব তার উপর অর্পণ করা কিছুতেই সমীচিন হতে পারে না। ব্যবস্থা রচনার জন্য গোড়াতেই যে উচ্চতর সমস্যাগুলোর সমাধান অপরিহার্য, ইন্দ্রিয়নিচয় তার একটিরও কোনো সমাধান পেশ করতে পারে না। তবে কি এসব সমস্যার সমাধান করা হবে অবাস্তব ধারণা-বিশ্বাস, অমূলক কল্পনা-খেয়াল এবং কুসংস্কার ও আজগুবী কিচ্ছা-কাহিনীর উপর নির্ভর করে? ‘আদ্-দীন’ বা পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা রচনার জন্য যেসব স্থায়ী নৈতিক মূল্য নির্ধারণ সংগ্রহ করতে একেবারে অক্ষম। এমতাবস্থায় মানব বুদ্ধি, বিশুদ্ধ, খাঁটি ও পরিপূর্ণ নৈতিক মূল্য নির্ধারণ করতে সমর্থ হবে বলে কিছুমাত্র ভরসা করা যায় কি? তদ্রুপ জীবন ব্যবস্থা (আদ্-দীন) রচনার জন্য যেসব প্রয়োজনীয় বিষয়ের আমি উল্লেখ করেছি, তার জন্য ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে নির্ভুল, বিশুদ্ধ ও পরিপূর্ণ উপাদান সংগ্রহ করা আদৌ সম্ভব নয়। কাজেই মানব বুদ্ধি কেন ব্যাপক ও পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা রচনা করতে সক্ষম নয়। উপরন্তু মানব বুদ্ধির সাথে ইচ্ছাশক্তি বলতে আর একটা বস্তু শনিগ্রহের ন্যায় স্বতন্ত্র সত্তা নিয়ে বিরাজ করছে। তা বুদ্ধিকে কোনো সুষ্ঠু ও বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে প্রতি পদক্ষেপ বাধা প্রদান করে এবং তাকে সহজ ও সঠিক পথে চলার গতি ব্যাহত করে বাঁকা ও ভুল পথে পরিচালিত না করে ছাড়ে না। কাজেই মানব বুদ্ধি ইন্দ্রিয়নিচয়ের সংগৃহিত তথ্যের সুবিন্যাসে এবং তা দ্বারা যুক্তি প্রদান করার ব্যাপারে কোনোরূপ ভুল করবে না বলে যদি ধরেও নেয়া হয়, তবুও তার আভ্যন্তরীণ দুর্বলতা নিবন্ধন জীবন ব্যবস্থা রচনার ন্যায় বিরাট দায়িত্ব বহন করার কোনো ক্ষমতাই নেই, একথা স্বতঃসিদ্ধ। এ দায়িত্ব তার উপর অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দিলে এক দিকে যেমন তার উপর যুলুম করা হবে, অন্যদিকে নিজের উপরও কম যুলুম করা হবে না।
বিজ্ঞান
এখন তৃতীয় উপায়টি সম্পর্কে আলোচনা করতে চাই। বিজ্ঞান বাস্তব অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণলব্ধ জ্ঞানকেই বুঝায়। এ জ্ঞানের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের ব্যাপারে বিজ্ঞানের কোনো ছাত্র অপেক্ষা আমি পশ্চাদপদই নই এবং তার একবিন্দু অবমাননাও আমি মোটেই পছন্দ করি না। কিন্তু তার স্বাভাবিক সসীমতাকে উপক্ষে করে তাকে অধিকতর প্রশস্ত, বিশাল ও অসীম শক্তিসম্পন্ন মনে করাকে আমি নিতান্ত অবৈজ্ঞানিক আচরণ বলে আখ্যা না দিয়ে পারি না। কারণ বিজ্ঞানে মূলতই সে শক্তি বর্তমান নেই। মানব বিজ্ঞানের নিগূঢ় তত্ত্ব সম্পর্কে অভিজ্ঞ প্রত্যেক ব্যক্তিই একতা স্বীকার করতে বাধ্য হবেন যে, অতি প্রাকৃতিক ও জড় অতীত সমস্যাবলী সম্পর্কে কোনো নির্দেশ দেয়ার ক্ষমতা বিজ্ঞানের নেই। যেহেতু সেই নিগূঢ় তত্ত্বও রহস্যের জগতে পৌঁছবার কোনো অবলম্বন আসলেই মানুষের করায়ত্বে নয়। অধিকন্তু তার প্রত্যক্ষ ও সরাসরি পর্যবেক্ষণ করার এবং অভিজ্ঞতালব্ধ তথ্য ও জ্ঞান রাশির সাহায্যে এমন কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতা মানুষের নেই, যাকে কোনোরূপ ‘বিজ্ঞান’ নামে অভিহিত করা যেতে পারে। জীবন ব্যবস্থা (আদ্-দীন) রচনার জন্য যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সুষ্ঠু মিমাংসা করা সর্বপ্রথম অপরিহার্য হয়ে পড়ে, তাই বিজ্ঞানের আওতার বাইরে অবস্থিত। তারপরে নৈতিক মান নির্ধারণ, তামাদ্দুন ও সংস্কৃতির মূলনীতি নির্বাচন এবং ভ্রান্ত পথ হতে বিরত রাখার জন্য সীমা নির্দেশ করার কর্তব্য বিজ্ঞানের সাহায্যে সমাধা করা যায় কিনা, এ প্রশ্ন অবশ্য জাগতে পারে। কিন্তু তার উপর পাল্টা প্রশ্ন উঠবে যে, তা যদি সম্ভব বলে ধরে নেয়া যায়, তাহলে কোন্ ব্যক্তির বা কোন্ দলের অথবা কোন্ কালের বিজ্ঞান এ কাজ সমাধা করবে? কাজেই অর্থহীন বিতর্কে না গিয়ে আমরা শুধু নীতি হিসেবে বিষয়টির আলোচনা করে দেখবো। প্রথম আমরা বিশ্লেষণ করে দেখবো যে, নিছক বৈজ্ঞানিক পন্থায় এ কাজ সম্পন্ন করার জন্য কি কি বুনিয়াদী শর্ত রয়েছে। সেজন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন হলো মানুষ এ দুনিয়াতে যেসব প্রাকৃতিক নিয়মের অধীন বসবাস করছে, সে সমস্ত নিয়মের তত্ত্বজ্ঞানের পরিপূর্ণ সমাহার। তার পরে মানুষের নিজের জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট নানা প্রকার জ্ঞান-বিজ্ঞানের পূর্ণতা লাভও অত্যাবশ্যক। তৃতীয়ত, এহেন বিশ্ব-প্রাকৃতিক এবং মানবিক এ উভয় প্রকারের জ্ঞান তথ্যের সমাহার একত্রীভূত হওয়াও অপরিহার্য। এবং এমন একটি পরিপূর্ণ মননশক্তির আবশ্যক যা এ তথ্য সমাহারকে পরস্পর শ্রেণীবিন্যাস করে, তা দ্বারা সুষ্ঠু নিয়মে যুক্তি প্রয়োগ করে মানুষের জন্য নৈতিক মূল্য সমাজ ও তামাদ্দুনিক নীতি নির্ধারণ এবং সর্বপ্রকার ভুল ভ্রান্তি হতে তাকে বাঁচাবার উপায় নির্দেশ করার কাজ করবে। কিন্তু সত্য বলতে কি, এ শর্তগুলো পূরণ করা, এতে প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো সংগ্রহ করা যেমন আজ পর্যন্ত আদৌ সম্ভব হয়নি। অনুরূপ আরো পাঁচ হাজার বছর পরেও তা কখনো সম্ভব হতে পারে বলে কোনো আশাও করা যায় না। অবশ্য দুনিয়ার সাথে সাথে গোটা মানবতার ধ্বংস প্রাপ্তির একদিন পূর্বে তা সম্ভব হলেও হতে পারে, কিন্তু তখন আর সেগুলোর কোনোই সার্থকতা থাকবে না।
ইতিহাস
মানুষের জ্ঞান অর্জনের সর্বশেষ উপায় হচ্ছে ইতিহাস। অন্য কথায় তাকে বলা যেতে পারে, অতীত মানুষের অভিজ্ঞতাসমূহের ঐতিহাসিক সঞ্চয় কিংবা আমলনামা। এ জিনিসটির গুরুত্ব ও সার্থকতা আমি অস্বীকার করি না। কিন্তু তবুও আমি একথা বলতে চাই একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে আপনিও তা বলতে বাধ্য হবেন যে, মানুষের জীবন ব্যবস্থা রচনার মতো বিরাট দায়িত্বপূর্ণ কাজ সুসম্পন্ন করার জন্য ঐতিহাসিক জ্ঞান সম্পদ মোটেই যথেষ্ট নয়। অতীতকাল হতে ইতিহাসের এ সম্পদ পূর্ণ বিশুদ্ধতা ও ব্যাপকতার সাথে আমাদের নিকট পৌছেছে কিনা, সে প্রশ্ন আমি তুলতে চাই না। পরন্তু, এহেন ঐতিহাসিক সম্পদের সাহায্যে মানুষের জন্য জীবন ব্যবস্থা রচনা করবে কোন্ ব্যক্তি? হেগেল? না মার্কস? না আর্নেষ্ট হেইকল? না অন্য কেউ? এ প্রশ্ন আমি জিজ্ঞেস করবো না। আমি শুধু এটাই জিজ্ঞেস করতে চাই যে, অতীত, বর্তমান, কিংবা ভবিষ্যতের কোন্ তারিখ পর্যন্ত ঐতিহাসিক রেকর্ড মানুষের জীবন ব্যবস্থা রচনার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান সংগ্রহ করতে পারবে? তেমন কোনো তারিখ নির্দিষ্ট করা যদি বাস্তবিকই সম্ভব হয়, তবে বলতেই হবে যে, তার পরবর্তীকালের মানুষ বড়ই ভাগ্যবান। আর পূর্বে যারা চলে গেছে, তাদের কথা আমাদের ভাবার প্রয়োজন নেই।
ইচ্ছাশক্তি
প্রথমে মানুষের ইচ্ছাশক্তি সম্পর্কে আলোচনা করে দেখা যাক। প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কি মানুষের পথপ্রদর্শক হতে পারে? এ শক্তিটি যদিও মানুষের প্রেরণা লাভের প্রকৃত উৎস উদ্বোধক, কিন্তু তা সত্ত্বেও এর মূল প্রকৃতিতে যেসব দূর্বলতা বিদ্যামন রয়েছে, তার কারণে এটা কিছুতেই মানুষের পথ প্রদর্শন করার যোগ্য হতে পারে না। শুধু পথ প্রদর্শন করাতো দূরের কথা, মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধিকে পর্যন্ত অনেক বিভ্রান্ত করে থাকে। নানাবিধ শিক্ষা-দীক্ষা ও ট্রেনিং দেয়ার পর এ শক্তিকে যতোদূরই আধুনিক, তেজস্বী ও জ্যোতিষ্মান করে তোলা হোক না কেন, কোনো গুরুতর ব্যাপার শেষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার দায়িত্ব এর উপর যখনই ন্যস্ত করা হবে, তখনি এটা শতকরা অন্তত নিরানব্বইটি অবস্থায় ভ্রান্তিপূর্ণ ফায়সালা দিবে, তাতে সন্দেহ নেই। কারণ এর অভ্যন্তরে যেসব ভাবধারা বর্তমান পাওয়া যায়, তা তাকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সাহায্য করে না, বরং বঞ্চিতকে কোনো না কোনো প্রকারে অবিলম্বে লাভ করার জন্য অনুকূল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বাধ্য করে। এটা মানুষের ইচ্ছাশক্তির স্বাভাবিক দুর্বলতা বিশেষ। কাজেই এ শক্তি একজন ব্যক্তিরই হোক কিংবা বিশেষ কোনো শ্রেণীর হোক অথবা রুশোর কথা অনুযায়ী সার্বজনীন ইচ্ছাশক্তি (general will) হোক না কেন, মানুষের জন্য কোনো পূর্ণ জীবন ব্যবস্থা রচনার উপযোগী যোগ্যতা স্বভাবতই কোনো ইচ্ছাশক্তির নেই। অধিকন্তু মানুষের ইচ্ছাশক্তি মানব জীবনের নিগূঢ় তত্ত্ব, তার লক্ষ্য, গতি ও পরিণতি সম্পর্কীয় উচ্চতর সমস্যাগুলোর (utimate problems) কোনো সমাধানই দান করতে পারে না।
বুদ্ধি
এখন মানুষের বুদ্ধি সম্পর্কে আলোচনা করে দেখা যাক। বুদ্ধির ক্ষমতা অসাধারণ, তার যোগ্যতা ও প্রতিভা অনস্বীকার্য। মানব জীবনে তার গুরুত্ব এবং মর্যাদাও কেউ উপেক্ষা করতে পারে না। পরন্তু মানুষের অভ্যন্তরে এটা অত্যন্ত তীব্র প্রেরণাদায়ক শক্তি, তাও স্বীকার না করে উপায় নেই ; কিন্তু সমস্যা এই যে, মানুষের জন্য জীবন ব্যবস্থা রচনা করার দায়িত্ব তার উপর ন্যস্ত করা হলে তা করবে কার বুদ্ধি? জায়েদের বুদ্ধি না বকরের বুদ্ধি? না সমগ্র মানুষের বুদ্ধি ? না মানুষের বিশেষ কোনো দল বা শ্রেণীর বুদ্ধি? বর্তমান যুগের মানুষের বুদ্ধি? না অতীত কোনো যুগের মানুষের বুদ্ধি? কি অনাগত যুগের মানুষের বুদ্ধি? আর এ প্রশ্ন না হয় না-ই করলাম, কারণ এর সঠিক জবাব দেয়া সম্ভব নয়। এ প্রসংগে সহজ একটি প্রশ্নই জিজ্ঞেস করতে চাই। মানব বুদ্ধির চৌহদ্দি পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করে দেখলে মানুষের জীবন ব্যবস্থা রচনা করার মতো বিরাট ও জটিল কাজ তার উপর ন্যস্ত করা কি কোনো রকমেই শোভা পায়?
বস্তুত কোনো কিছু সম্পর্কে বুদ্ধির সিদ্ধান্ত গ্রহণ একান্তরূপে নির্ভর করে পঞ্চইন্দ্রিয় কর্তৃক সংগৃহীত তথ্যের উপর। এটা ভুল তথ্য সংগ্রহ করলে বুদ্ধি ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বাধ্য। তা অসম্পূর্ণ তথ্য উপস্থিত করলে বুদ্ধির সিদ্ধান্ত অসম্পূর্ণই হবে এবং যেসব ব্যাপারে ইন্দ্রিয় কোনো তথ্যই সংগ্রহ করতে পারবে না, বুদ্ধির আত্মজ্ঞান থাকলে সেসব ব্যাপারে তা কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করারই দুঃসাহস করবে না। আর তা অন্ধ ও দাম্ভিক হলে অন্ধকারে কাষ্ঠ নির্মিত তীর নিক্ষেপ করে অবশ্যই ব্যর্থ হবে। যে বুদ্ধির পরিধি এতো সীমাবদ্ধ ও সংকীর্ণ, মানব জাতির জন্য এক পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা রচনা করার দায়িত্ব তার উপর অর্পণ করা কিছুতেই সমীচিন হতে পারে না। ব্যবস্থা রচনার জন্য গোড়াতেই যে উচ্চতর সমস্যাগুলোর সমাধান অপরিহার্য, ইন্দ্রিয়নিচয় তার একটিরও কোনো সমাধান পেশ করতে পারে না। তবে কি এসব সমস্যার সমাধান করা হবে অবাস্তব ধারণা-বিশ্বাস, অমূলক কল্পনা-খেয়াল এবং কুসংস্কার ও আজগুবী কিচ্ছা-কাহিনীর উপর নির্ভর করে? ‘আদ্-দীন’ বা পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা রচনার জন্য যেসব স্থায়ী নৈতিক মূল্য নির্ধারণ সংগ্রহ করতে একেবারে অক্ষম। এমতাবস্থায় মানব বুদ্ধি, বিশুদ্ধ, খাঁটি ও পরিপূর্ণ নৈতিক মূল্য নির্ধারণ করতে সমর্থ হবে বলে কিছুমাত্র ভরসা করা যায় কি? তদ্রুপ জীবন ব্যবস্থা (আদ্-দীন) রচনার জন্য যেসব প্রয়োজনীয় বিষয়ের আমি উল্লেখ করেছি, তার জন্য ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে নির্ভুল, বিশুদ্ধ ও পরিপূর্ণ উপাদান সংগ্রহ করা আদৌ সম্ভব নয়। কাজেই মানব বুদ্ধি কেন ব্যাপক ও পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা রচনা করতে সক্ষম নয়। উপরন্তু মানব বুদ্ধির সাথে ইচ্ছাশক্তি বলতে আর একটা বস্তু শনিগ্রহের ন্যায় স্বতন্ত্র সত্তা নিয়ে বিরাজ করছে। তা বুদ্ধিকে কোনো সুষ্ঠু ও বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে প্রতি পদক্ষেপ বাধা প্রদান করে এবং তাকে সহজ ও সঠিক পথে চলার গতি ব্যাহত করে বাঁকা ও ভুল পথে পরিচালিত না করে ছাড়ে না। কাজেই মানব বুদ্ধি ইন্দ্রিয়নিচয়ের সংগৃহিত তথ্যের সুবিন্যাসে এবং তা দ্বারা যুক্তি প্রদান করার ব্যাপারে কোনোরূপ ভুল করবে না বলে যদি ধরেও নেয়া হয়, তবুও তার আভ্যন্তরীণ দুর্বলতা নিবন্ধন জীবন ব্যবস্থা রচনার ন্যায় বিরাট দায়িত্ব বহন করার কোনো ক্ষমতাই নেই, একথা স্বতঃসিদ্ধ। এ দায়িত্ব তার উপর অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দিলে এক দিকে যেমন তার উপর যুলুম করা হবে, অন্যদিকে নিজের উপরও কম যুলুম করা হবে না।
বিজ্ঞান
এখন তৃতীয় উপায়টি সম্পর্কে আলোচনা করতে চাই। বিজ্ঞান বাস্তব অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণলব্ধ জ্ঞানকেই বুঝায়। এ জ্ঞানের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের ব্যাপারে বিজ্ঞানের কোনো ছাত্র অপেক্ষা আমি পশ্চাদপদই নই এবং তার একবিন্দু অবমাননাও আমি মোটেই পছন্দ করি না। কিন্তু তার স্বাভাবিক সসীমতাকে উপক্ষে করে তাকে অধিকতর প্রশস্ত, বিশাল ও অসীম শক্তিসম্পন্ন মনে করাকে আমি নিতান্ত অবৈজ্ঞানিক আচরণ বলে আখ্যা না দিয়ে পারি না। কারণ বিজ্ঞানে মূলতই সে শক্তি বর্তমান নেই। মানব বিজ্ঞানের নিগূঢ় তত্ত্ব সম্পর্কে অভিজ্ঞ প্রত্যেক ব্যক্তিই একতা স্বীকার করতে বাধ্য হবেন যে, অতি প্রাকৃতিক ও জড় অতীত সমস্যাবলী সম্পর্কে কোনো নির্দেশ দেয়ার ক্ষমতা বিজ্ঞানের নেই। যেহেতু সেই নিগূঢ় তত্ত্বও রহস্যের জগতে পৌঁছবার কোনো অবলম্বন আসলেই মানুষের করায়ত্বে নয়। অধিকন্তু তার প্রত্যক্ষ ও সরাসরি পর্যবেক্ষণ করার এবং অভিজ্ঞতালব্ধ তথ্য ও জ্ঞান রাশির সাহায্যে এমন কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতা মানুষের নেই, যাকে কোনোরূপ ‘বিজ্ঞান’ নামে অভিহিত করা যেতে পারে। জীবন ব্যবস্থা (আদ্-দীন) রচনার জন্য যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সুষ্ঠু মিমাংসা করা সর্বপ্রথম অপরিহার্য হয়ে পড়ে, তাই বিজ্ঞানের আওতার বাইরে অবস্থিত। তারপরে নৈতিক মান নির্ধারণ, তামাদ্দুন ও সংস্কৃতির মূলনীতি নির্বাচন এবং ভ্রান্ত পথ হতে বিরত রাখার জন্য সীমা নির্দেশ করার কর্তব্য বিজ্ঞানের সাহায্যে সমাধা করা যায় কিনা, এ প্রশ্ন অবশ্য জাগতে পারে। কিন্তু তার উপর পাল্টা প্রশ্ন উঠবে যে, তা যদি সম্ভব বলে ধরে নেয়া যায়, তাহলে কোন্ ব্যক্তির বা কোন্ দলের অথবা কোন্ কালের বিজ্ঞান এ কাজ সমাধা করবে? কাজেই অর্থহীন বিতর্কে না গিয়ে আমরা শুধু নীতি হিসেবে বিষয়টির আলোচনা করে দেখবো। প্রথম আমরা বিশ্লেষণ করে দেখবো যে, নিছক বৈজ্ঞানিক পন্থায় এ কাজ সম্পন্ন করার জন্য কি কি বুনিয়াদী শর্ত রয়েছে। সেজন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন হলো মানুষ এ দুনিয়াতে যেসব প্রাকৃতিক নিয়মের অধীন বসবাস করছে, সে সমস্ত নিয়মের তত্ত্বজ্ঞানের পরিপূর্ণ সমাহার। তার পরে মানুষের নিজের জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট নানা প্রকার জ্ঞান-বিজ্ঞানের পূর্ণতা লাভও অত্যাবশ্যক। তৃতীয়ত, এহেন বিশ্ব-প্রাকৃতিক এবং মানবিক এ উভয় প্রকারের জ্ঞান তথ্যের সমাহার একত্রীভূত হওয়াও অপরিহার্য। এবং এমন একটি পরিপূর্ণ মননশক্তির আবশ্যক যা এ তথ্য সমাহারকে পরস্পর শ্রেণীবিন্যাস করে, তা দ্বারা সুষ্ঠু নিয়মে যুক্তি প্রয়োগ করে মানুষের জন্য নৈতিক মূল্য সমাজ ও তামাদ্দুনিক নীতি নির্ধারণ এবং সর্বপ্রকার ভুল ভ্রান্তি হতে তাকে বাঁচাবার উপায় নির্দেশ করার কাজ করবে। কিন্তু সত্য বলতে কি, এ শর্তগুলো পূরণ করা, এতে প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো সংগ্রহ করা যেমন আজ পর্যন্ত আদৌ সম্ভব হয়নি। অনুরূপ আরো পাঁচ হাজার বছর পরেও তা কখনো সম্ভব হতে পারে বলে কোনো আশাও করা যায় না। অবশ্য দুনিয়ার সাথে সাথে গোটা মানবতার ধ্বংস প্রাপ্তির একদিন পূর্বে তা সম্ভব হলেও হতে পারে, কিন্তু তখন আর সেগুলোর কোনোই সার্থকতা থাকবে না।
ইতিহাস
মানুষের জ্ঞান অর্জনের সর্বশেষ উপায় হচ্ছে ইতিহাস। অন্য কথায় তাকে বলা যেতে পারে, অতীত মানুষের অভিজ্ঞতাসমূহের ঐতিহাসিক সঞ্চয় কিংবা আমলনামা। এ জিনিসটির গুরুত্ব ও সার্থকতা আমি অস্বীকার করি না। কিন্তু তবুও আমি একথা বলতে চাই একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে আপনিও তা বলতে বাধ্য হবেন যে, মানুষের জীবন ব্যবস্থা রচনার মতো বিরাট দায়িত্বপূর্ণ কাজ সুসম্পন্ন করার জন্য ঐতিহাসিক জ্ঞান সম্পদ মোটেই যথেষ্ট নয়। অতীতকাল হতে ইতিহাসের এ সম্পদ পূর্ণ বিশুদ্ধতা ও ব্যাপকতার সাথে আমাদের নিকট পৌছেছে কিনা, সে প্রশ্ন আমি তুলতে চাই না। পরন্তু, এহেন ঐতিহাসিক সম্পদের সাহায্যে মানুষের জন্য জীবন ব্যবস্থা রচনা করবে কোন্ ব্যক্তি? হেগেল? না মার্কস? না আর্নেষ্ট হেইকল? না অন্য কেউ? এ প্রশ্ন আমি জিজ্ঞেস করবো না। আমি শুধু এটাই জিজ্ঞেস করতে চাই যে, অতীত, বর্তমান, কিংবা ভবিষ্যতের কোন্ তারিখ পর্যন্ত ঐতিহাসিক রেকর্ড মানুষের জীবন ব্যবস্থা রচনার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান সংগ্রহ করতে পারবে? তেমন কোনো তারিখ নির্দিষ্ট করা যদি বাস্তবিকই সম্ভব হয়, তবে বলতেই হবে যে, তার পরবর্তীকালের মানুষ বড়ই ভাগ্যবান। আর পূর্বে যারা চলে গেছে, তাদের কথা আমাদের ভাবার প্রয়োজন নেই।
0 comments: