অবশেষে শহীদী কাফেলায় শরিক হলেন বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলনের প্রতিভাদীপ্ত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামান। মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে তিনি দৃঢ়তা ও ঈমানের এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
বলেছেন, রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চওয়ার প্রশ্নই উঠে না। ক্ষমা চাইবেন তো শুধু আল্লাহর কাছে। আমার স্বপ্ন এদেশে ইসলামী শাসন কায়েম করা। জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বেই এদেশে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। পুত্র সাক্ষাৎ শেষে মিডিয়াকে জানান, তার বাবা বলেছেন, তার সাথে বিচারের নামে প্রহসন করা হয়েছে। ১৮ বছরের একজন কিশোরকে মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসিয়ে দেয়া হয়েছে। এর বিচারের ভার তিনি আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, বাবার মনোবল দৃঢ় আছে। তিনি দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন। বাবা বিচলিত নন, আমরা হাসিমুখে বিদায় দিয়ে গেলাম।
জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল, বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, লেখক, ইসলামী চিন্তাবিদ, জনগণের প্রিয় নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে হত্যার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে এবং ২ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করে জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমীর মকবুল আহমাদ গতকাল শনিবার রাত ১১টায় বিবৃতি দিয়েছেন। আজও চলছে প্রতিবাদ কর্মসূচি। বিবৃতিতে তিনি বলেন, সরকার অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল, বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, লেখক, ইসলামী চিন্তাবিদ, জনগণের প্রিয় নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে ১১ এপ্রিল রাত ১০টার পরে হত্যা করেছে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য সরকার তার বিরুদ্ধে মিথ্যা, বায়বীয় ও কাল্পনিক অভিযোগে ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দায়ের করে। এ মামলায় দলীয় লোকদের দ্বারা মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করে। সাক্ষীদের পরস্পরবিরোধী ও অসঙ্গতিপূর্ণ বক্তব্য থেকে তার বিরুদ্ধে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের বিষয়টি বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসীর নিকট উন্মোচিত হয়।
মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিচার ও মৃত্যুদ- সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, মানবাধিকার সংগঠন, আন্তর্জাতিক আইন ও যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক বিশেষজ্ঞগণ। ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি আবদুল জব্বার বলেন, কামারুজ্জামান গণমানুষের প্রিয় নেতা। ষড়যন্ত্রের শিকার এই মহান নেতা মানুষের কাছে নন্দিত।
মুহাম্মদ কামারুজ্জামান যেমন একদিকে সফল রাজনীতিবিদ ও সংগঠক অন্যদিকে একজন সফল সাংবাদিক ও সম্পাদক। তারই সফল সম্পাদনায় সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকা আজ পরিচিত নাম।
রাজনৈতিক ময়দানে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের পাশাপাশি মুহাম্মদ কামারুজ্জামান বাংলাদেশের রাজনীতি, ইসলামী সংগঠন ও আন্দোলন, গণতন্ত্র ও তার বিকাশ, নির্বাচন, গণমাধ্যম, সমাজ সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রচুর চিন্তা ও গবেষণা করেন। তিনি বাংলাদেশে অবাধ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাসহ ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠা ও তার কৌশল নিয়ে বেশ কয়েকটি মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেছেন এবং সেই বইগুলো পাঠকমহলে বেশ সমাদৃত হয়েছে। ছাত্রজীবন শেষে মুহাম্মদ কামারুজ্জামান সাংবাদিকতাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৯৮০ সালে তিনি বাংলা মাসিক ‘ঢাকা ডাইজেস্ট’ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৮১ সালে তাকে সাপ্তাহিক ‘সোনার বাংলা’ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। মাত্র ১ জন পিয়ন ও ১ জন কর্মচারী নিয়ে যাত্রা শুরু করে সোনার বাংলা।
সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সোনার বাংলায় ক্ষুরধার লেখনীর কারণে এরশাদের শাসনামলে পত্রিকাটির প্রকাশনা নিষিদ্ধ হয়। ‘সোনার বাংলা’ রাজনৈতিক কলাম ও বিশ্লেষণ বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং পত্রিকাটি দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক সাপ্তাহিকের মর্যাদা লাভ করে। কারাগারে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মুহাম্মদ কামারুজ্জামান পত্রিকাটির সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এছাড়া তিনি সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্যোগে কতিপয় ব্যক্তির সহযোগিতায় একটি ব্যতিক্রমধর্মী সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ‘নতুন পত্র’ প্রকাশ করেন, অবশ্য এ পত্রিকাটির প্রকাশনা বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ১৯৮৩ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত দশ বছর দৈনিক সংগ্রামের নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। মুহাম্মদ কামারুজ্জামান জাতীয় প্রেস ক্লাবের একজন সদস্য এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্য ছিলেন। ১৯৮৫-৮৬ সাল পর্যন্ত তিনি অবিভক্ত বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন-বিএফইউজে’র কার্যনির্বাহী পরিষদের নির্বাচিত সদস্য ছিলেন।
পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ১৯৭৯ সালে মুহাম্মদ কামারুজ্জামান জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করেন, একই বছর তিনি জামায়াতের রুকন (সদস্য) হন। ১৯৮১-৮২ সালে তিনি কিছুদিনের জন্য ঢাকা মহানগরী জামায়াতের জয়েন্ট সেক্রেটারি ছিলেন। ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯২ সালে তাকে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। জামায়াতের কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক কমিটি ও লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য হিসেবে বিগত স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ১৯৮৩-৯০ পর্যন্ত তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৯৩-৯৫ সাল পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য।
জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান জামায়াতের নির্বাহী কমিটি, কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ ও বিভিন্ন কমিটির সদস্য এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ক সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসায় পর গঠিত চারদলের কেন্দ্রীয় লিয়াজোঁ কমিটির অন্যতম শীর্ষ নেতা হিসেবে তার অবদান উল্লেখযোগ্য।
ইসলামী ও জাতীয়তাবাদী শক্তির ঐক্য প্রচেষ্টায় তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। এজন্য দলীয় রাজনীতি ছাড়াও বিভিন্ন ফোরামে সভা-সমাবেশ, সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে তার সক্রিয় উপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়।
বিদেশ ভ্রমণ
জননেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামান বহু দেশে ভ্রমণ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে সৌদি আরব, ইরান, নেপাল, ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, হংকং, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কানাডা, ফ্রান্স, সুইডেন, জাপান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, আস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ইতালী, জার্মানী, তুরস্ক, ইয়ামেন, ব্রুনাই, বাহরাইন ও কুয়েত।
লেখক কামারুজ্জামান
মুহাম্মদ কামারুজ্জামান দেশী বিদেশী বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কলাম লিখতেন। পত্র-পত্রিকা ও বিভিন্ন জার্নালে তার লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তার লিখিত বইগুলো পাঠক সমাদৃত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আধুনিক যুগে ইসলামী বিপ্লব, পশ্চিমা চ্যালেঞ্জ ও ইসলাম, বিশ্ব পরিস্থিতি ও ইসলামী আন্দোলন, সংগ্রামী জননেতা অধ্যাপক গোলাম আযম, সাঈদ বদিউজ্জামান নুরসী ইত্যাদি।
কর্মে ও চিন্তায় মুহাম্মদ কামারুজ্জামান একজন সেল্ফ-মেইড মানুষ। জীবনের নানা স্তরে সংগ্রামের মাধ্যমে তিনি নেতৃত্বেও উচ্চতর পদে এসেছেন। ছাত্র ও ইসলামী আন্দোলনের গতিকে বেগবান করার জন্য সমগ্র বাংলাদেশ পরিভ্রমণ করেছেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ছিল তার মুখর পদচারণা। বিশেষত ছাত্র-তরুণ সমাজের কাছে তিনি ছিলেন উজ্জ্বল উদাহরণ। তিনি সর্বদাই বাংলাদেশে মেধাবী ও যোগ্যতাসম্পন্ন মানবসম্পদ গঠনের প্রতি জোর দিয়েছেন। বহুজনকে তিনি দক্ষতা ও আত্মবিকাশের পথ করে দিয়েছেন। সংগঠনের মানব সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রেও তিনি যোগ্য, সৎ. মেধাবীদের প্রতি সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। তাঁর মৃত্যুতেই তাঁর মিশনের পরিসমাপ্তি ঘটবে না। বরং তাঁর আদর্শের পথে নিবেদিত লক্ষ-কোটি জনতা তাঁর মিশনকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে তিনি ইসলামকে বিজয়ী করার সংগ্রামের প্রতি নিজের অকুণ্ঠ সমর্থন ও আস্থার কথা ভয়হীন চিত্তে প্রকাশ করেছেন। ইসলাম কায়েমের লড়াই সাফল্য লাভের মাধ্যমেই তাঁর সংগ্রাম সার্থকতায় পরিণত হবে।
মুহাম্মদ কামারুজ্জামান কোনো ব্যক্তি নন, একমাত্র আল্লাহর প্রতি নিজেকে আত্মসমর্পণ করে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। দেশবাসীর কাছে জানিয়ে গেছেন নিজের আকুতি ও ইচ্ছা। আর এটা তো মৌলিক সত্য, যারা আল্লাহর উপর নির্ভর করে, আস্থা রাখে, আল্লাহই তাদের জন্য যথেষ্ট। মৃত্যুতেও তিনি ঈমানের দাওয়াকেই বুলন্দ করলেন। বাংলাদেশের জমিনে ঈমানের আন্দোলনের চলমান ধারায় তাই তিনি রয়ে যাবেন অমিল এক আদর্শ-ব্যক্তিত্ব স্বরূপ।
শহীদী কাফেলায় কামারুজ্জামান
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
রিসেন্ট ব্লগ পোষ্টস
বিষয়শ্রেণী
রাইটার
প্রিয়-ক্লিক
কিছু বই
- অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা
- অর্থনীতিতে রাসূল (সা) এর দশ দফা
- আদর্শ মানব মুহাম্মদ (সা)
- আসহাবে রাসূলের জীবনকথা
- ইসলাম ও জিহাদ
- ইসলাম পরিচিতি
- ইসলামী আন্দোলন : সাফল্যের শর্তাবলী
- ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক
- ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি
- ইসলামী দাওয়াত ও কর্মনীতি
- ইসলামী নেতৃত্বের গুণাবলী
- ইসলামী বিপ্লবের পথ
- ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন
- ইসলামী সমাজে মজুরের অধিকার
- একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণঃ তার থেকে বাঁচার উপায়
- চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান
- দায়ী’ ইলাল্লাহ - দা’ওয়াত ইলাল্লাহ
- নামাজ কেন আজ ব্যর্থ হচ্ছে
- নামায-রোজার হাকীকত
- মোরা বড় হতে চাই
- যাকাতের হাকীকত
- রাসূলুল্লাহর বিপ্লবী জীবন
- শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী ও তাঁর চিন্তাধারা
- সত্যের সাক্ষ্য
- হেদায়াত
0 comments: