১. কামারুজ্জামান ভাইয়ের সাথে প্রথম প্রত্যক্ষ সাক্ষাতে আমি অবাক হয়েছিলাম!
স্যুট-টাই পরা মার্জিত রুচির ড্যামস্মার্ট একজন মানুষ। তেলমাখা কালো চুলগুলো সুন্দর করে আঁচড়ানো। মসৃণ চেহারাটায় ব্যক্তিত্বের ছাপ সুস্পষ্ট। স্থিরদৃষ্টি এবং পোশাক পরিচ্ছেদে পরিপাটি ব্যক্তিটি প্রথম দর্শনেই যে কারও আস্থা বা শ্রদ্ধার অংশীদার হতে বাধ্য।
আমি ছিলাম দ্বিধান্বিত, ইনি মুহাম্মদ কামারুজ্জামান!
ইসলামী রাজনীতির একজন অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তির স্যুটেট-বুটেড গেটআপ নিয়ে ছিল আমার বিস্ময়! ব্যক্তিগত সান্নিধ্যে আসার পর আরও অবাক হয়েছি তার বাস্তববাদী আত্মোপলব্ধি দেখে। আমরা সাধারণত: সমলোচনা করি যে আমার পছন্দ নয় তার অর্থাৎ প্রতিপক্ষের। কিন্তু তিনি বলতেন নিজেদের দূর্বলতার কথা। আক্ষেপ করতেন স্বীয় সীমাবদ্ধতা বা ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে।
আমরা কথায় কথায় বলি, আগামী দিনের সূযোর্দয়ের মতই বিপ্লব এবং বিজয় অনিবার্য। তিনি বলতেন বিপ্লব সবসময় সফল হবে এমন কথা নেই। জয় এবং পরাজয় উভয় অবস্থার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
জনজোয়ার দেখে আমাদের মনেহতো এটা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানি। তিনি এর মাঝে খুঁজে পেতেন কঠিন দায়িত্ববোধজনিত প্রতিকূলতার আভাস। ফলে আমার মত স্থুলকায় অনুসারী মাত্রই থমকে যেতাম। কামারুজ্জামান ভাই এমন কেন!
যে সমাজে আমাদের বিচরণ সেখানে ইসলামী আন্দোলনের উচ্চ পর্যায়ের একজন নেতার এই গেট-আপ এবং সেলফ ক্রিটিক মাইন্ড কে ভ্রুকুটি করার মানুষ প্রচুর। তিনি এসব জানতেন-বুঝতেন কিন্তু যে দৃষ্টি দিয়ে তিনি এসকল ভ্রুকুটিকে উপেক্ষা করতেন তার নাম দূরদৃষ্টি। ফলে একান্ত আপন হলেও তাঁর চিন্তা ও দৃষ্টির প্রখরতা ছিল আমাদের অচেনা। আমরা কেউ বিশ্বাস করিনি নিরপরাধ মানুষ গুলোর গলায় তারা শেষ পর্যন্ত ফাঁসির দড়ি ঝুলিয়ে ছাড়বে। হ্যাঁ একমাত্র মুহাম্মদ কামারুজ্জামান তিনি বহু আগেই প্রথম বলেছিলেন "আমাদের জন্য তোমরা আর ভেবোনা, আমাদের বাদ দিয়েই সামনে এগুবার চিন্তা করো। কারণ আমাদের সম্ভবত: তোমরা আর ফেরৎ পাচ্ছোনা"।
আজ কাছে থাকলে তিনি হয়তো হাসিমুখে নিজ হাতে চোখের জমাট অশ্রুগুলো মুছে দিতেন। এ অশ্রু মুছে আর কি হবে! ভেজা চোখেই হোকনা অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর।
বড় করে দেখতে |
২.
স্মৃতি’র নাম আজ বিষাদ।
যতবার কল্পনায় তার ফাঁসির মঞ্চ দেখি, দেখি তার নিথর রক্তঝরা কফিন। ততবার আমি আমাকে আবিস্কার করি এক অক্ষম বিপ্লবী হিসেবে।
প্রিয় সিপাহসালার হে, কথা ছিল ঝাঁকে ঝাঁকে বুলেট তোমাকে বিঁধতে আসলে আমরা দেয়াল হয়ে দাড়াবো। অথচ উঁচু দেয়াল ঘেরা প্রকোষ্ঠের ভেতর ওরা তোমাকে হত্যা করেছে। আমরা দেয়াল ভাংতে পারিনি। সত্য, যুক্তি আর বাঁধভাঙ্গা চোখের জলে দেয়াল ভাঙ্গা যায়না। যে ক্ষোভ আর ঘৃণার শক্তি দিয়ে দেয়াল ভাঙ্গতে হয়, বহু আগেই তুমি সেই ক্ষোভ আর ঘৃণাকে ভালোবাসায় রুপান্তরের পাঠ দিয়েছ। তাই আজ তোমার শেখানো ভালোবাসায় তোমাকে বিদায় দিলাম।
মুহাম্মদ কামারুজ্জামান। আমার ভাই, আমার দায়িত্বশীল এবং শিক্ষক।
ব্যক্তিগতভাবে সবাই আমাকে আমার ছোট(ডাক নাম)নামে ডাকলেও কেন যেন কামারুজ্জামান ভাই ডাকতেন “মজিব” বলে। আহ্ কী মমতা সেই ডাকে। উত্তরসূরীদের প্রতি একইসাথে স্নেহ এবং সম্মানসূচক আচরণ ছিল তার এক অসাধারণ শিক্ষা। স্মৃতিগুলো ভুলে থাকতে পারলেই আজ ভালো হতো। কতই না মধুর সেই সময়গুলো! আড্ডার ছলে কৌশলে ছোটদের বন্ধু বনে যাওয়া। মাণ-অভিমাণ, মৃদু ঝগড়া, কানটা আলতো করে টেনে ধরে পড়ালেখা না করার জন্য শাসানো।
কাল স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে খুঁজে পেলাম জেল থেকে আমাকে লেখা তার সর্বশেষ চিঠি। ভুলেই গিয়েছিলাম তার সেই চিঠির কথা। বুকের সাথে লেপটে ধরেছিলাম কতক্ষণ জানিনা। তার মায়ের জানাজার দিন জনাকীর্নের ভীড়ে তিনি আমার ছেলেকে দেখেছেন বলে জানালেন। আমি যে মুটিয়ে গেছি সেটার ব্যপারে সতর্ক করলেন। বড় ছেলে ওয়ামী সম্পর্কে অনেক কথা লিখলেন। দায়িত্ব দিলেন তার দিকে সার্বিক নজর রাখার জন্য। আন্দোলন এগিয়ে নিতে আমাদের ভূমিকা নেয়ার তাগিদ দিলেন। দিগন্তের সকল কর্মীদের প্রতি বর্ষপূর্তির শুভেচ্ছা জানালেন- এই চিঠি যেন এক অদ্ভুত দিকনির্দেশনা। কি নেই তাতে?
কাল পর্যন্ত মুহাম্মদ কামারুজ্জামান কে নিয়ে আমরা ছিলাম উদ্বিগ্ন। কিন্তু কি আশ্চর্য! আজ তিনি আমাদের শক্তি। তার স্মৃতি আজ অনুপ্রেরণা। তার সাধারণ কথাগুলো আজ যেন ঐতিহাসিক বাণী ও প্রত্যাদেশ
-Mojibur Rahman Monju
(★লিখবো করে আর লিখা হয়নি আজ লিখে ফেললাম★)
আজ থেকে ৪ বছর আগে দীর্ঘ ৫০ দিনের মোরাল ক্যাম্পেইনে থাকার সুযোগ হয়েছিলো, ছিলাম ১৭ জন। আমদানি নামক আবাসিকে প্রবেশের পর এক ভাই এসে আমাকে বলল #কামারুজ্জামান ভাই আপনাদের সালাম দিয়েছেন আর সুপারের নিকট চিঠি দিয়েছেন যাতে আপনাদের এক সাথে থাকার সুযোগ করে দেওয়া হয়। প্রিয় #কামারুজ্জামান ভাই সেদিন সুপার আপনার কথা শুনেনি আমাদেরকে আলাদা আলাদা ভাবে থাকতে হয়েছিলো।
তার কদিন পরেই একটা চিঠি পাঠালেন আমার কাছে আমাদের খোজ খবর জানতে চেয়ে, আর বললেন উনার সাথে দেখা করতে যদিও তারিখটা আমার এখন মনে নেই!!! নির্দিষ্ট করা দিনে অধীর আগ্রহে বসেছিলাম আমদানির পাশে আম গাছ তলায়, অবশেষে দেখা হলো, হাত মুসাফা করে সবার খোজ খবর নিলেন আর বললেন, "ধৈর্য ধরো, আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাদের পরীক্ষা করেন, এ সুযোগ সবার হয়না, তোমরা সৌভাগ্যের অধিকারী, সবাইকে আমার সালাম জানাবে, তোমাদের জন্য কিছু খাবার রেখেছি পাঠিয়ে দেবো আর কোন সমস্যা হলে উনাকে জানাতে বলল, তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে গেলেন"!!! যেদিন উনি খাবার পাঠালেন সেদিন সব খাবার আমি সবাইকে ভাগ করে দিলাম আর যিনি খাবার এনেছেন তিনি বললেন "স্যার আপনাদের জন্য উনার কাছে যা খাবার ছিলো সব পাঠিয়ে দিয়েছেন, কিছুই উনার কাছে রাখেননি "!!! চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি, খাবার নামতেই চাইলোনা গলা দিয়ে!!!
কি মায়া মমতা, কি ভালোবাসা এই মানুষটির!!! তার কিছুদিন পরেই উনি আবার দেখা করতে বললেন, দেখা করলাম আর বললেন " মাসরুর আর কয়েকটাদিন পরেই তোমরা বের হবে খুব কষ্ট হচ্ছে আমি বুঝি, একটু সবর করো, কিছু লাগলে আমাকে বলো"!! জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে ছিলাম আর বললাম " আমরা বের হয়ে যাবো অথচ আপনাকে রেখে কিভাবে বের হই??" উনি বললেন, " তোমাদের অনেক দায়িত্ব এখন, অনেক কাজ বাকি, এ কাজগুলো তোমাদেরই কাঁধে নিতে হবে, সামনের দিনগুলো অনেক কঠিন!!!" নিজ হাতে চোখের পানি মুছে দিয়ে বললেন "আমাদের জন্য দোয়া করো, মনে রাখবে সত্যের মৃত্যু নেই, আল্লাহ সহায়, আল্লাহ হাফেজ" অনেক্ষন দাড়িয়ে উনার চলে যাওয়া লক্ষ্য করলাম আর উনার শরীর থেকে একটা সুঘ্রাণ পাচ্ছিলাম, অনেক্ষন পেয়েছিলাম, সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম!!!
সুপ্রিয় ভাই, শ্রদ্ধাভাজন দায়িত্বশীল, আমরা কতটুকু আল্লাহর প্রিয় বান্দা হতে পেরেছি সেটা জানিনা, শুধু জানি আপনি ঈমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের কাতারে আপনার অবস্থান!!! আর হ্যাঁ সেই সুঘ্রাণ!!! আপনিতো জান্নাতের পাখি জান্নাতের মেহমান তাই সেই সুঘ্রাণটুকু সেই সুসংবাদটুকুই বহন করেছে!!! হে আল্লাহ, নিজ দুর্বলতার কারণে আর দেখা হয়নি এই রাহাবারের সাথে, আজ অশ্রুসিক্ত নয়নে তোমার কাছে ফরিয়াদ করছি উনাকে তুমি শাহাদাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করুন। আর সেই সাথে ফরিয়াদ করছি, "সেই সংগ্রামী মানুষের কাতারে আমাকে রেখো রহমান"..!!!...
- Masrur Nishat
0 comments: