শহীদ আবিদ বিন ইসলাম। আহ্ আজকে যদি আমার জন্য এই জায়গাটা হতো তাহলে নিজেকে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে সঁপে দিতে পারতাম। এদেশের ছাত্রসমাজের প্রিয় কাফেলা, মেধাবী ছাত্রদের প্রিয় ঠিকানা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম ছাত্রসংগঠনের নাম বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির।
শহীদ আবিদ বিন ইসলামের কথা আমার মনে বারবার সকাল- সন্ধ্যা নাড়া দিচ্ছে, কারণ ৩ ফেব্রুয়ারি আমি আবিদ বিন ইসলাম যে ওয়ার্ডে কাজ করেন সে ওয়ার্ডের মাসিক সাথী বৈঠকে গিয়েছিলাম। এর একদিন পরই ৫ ফেব্রুয়ারি তিনি শাহাদত বরণ করেছেন। সেদিন সাথী বৈঠকে দেখলাম শহীদ আবিদ বিন ইসলাম অন্য সাথী ভাইদের রিপোর্টের ওপর বিভিন্ন প্রশ্ন করেন এবং পরামর্শ দেন। আর একটা আমাকে প্রশ্ন করে, বগুড়ায় চারজন ভাইয়ের শাহাদতের প্রতিবাদে ৩১ জানুয়ারি চট্টগ্রাম মহানগরী দক্ষিণ সন্ধ্যায় আগ্রাবাদ ছোট পুল থেকে বড়পুল বিক্ষোভ মিছিল করেছিল। ঐ মিছিলে ব্যাপক গাড়ি, দোকানপাট ভাঙচুর হয়, এ ব্যাপারে সংগঠনের সিদ্ধান্ত কী ছিল? আমি এ প্রশ্নের উত্তর বুঝিয়ে দিয়ে সাথী বৈঠকের শেষপর্যায়ে বক্তব্য দিতে গিয়ে বললাম আজকে যারা দ্বীন বিজয়ের জন্য সারা জীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, দেশ-বিদেশে তাফসির পেশ করেছেন এবং যার বক্তব্য শুনে অনেক অমুসলিম মুসলমান হয়েছেন তাদেরকে কারাগারের অন্ধকারে দিন যাপন করতে হচ্ছে। ঐ সকল জামায়াত নেতা এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় ছাত্র-আন্দোলন সম্পাদক শামসুল আলম গোলাপ ভাইসহ সকল নেতা কর্মীর মুক্তির আন্দোলনের জন্য হয়তো আমাদের মধ্যে হতেও শহীদ হতে হবে।
ঐ মিছিলেও পুলিশ গুলি চালায়। প্রায় ৫০-৬০টি টিয়ার শেল নিক্ষেপ করার ফলে আকাশ-বাতাস অন্ধকারে ছেয়ে যায়। পুলিশের গুলির আওয়াজে সাধারণ মানুষ এবং ব্যবসায়ীরা দোকানপাট বন্ধ করে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করেন, জামায়াত-শিবিরের শামিম, সাজ্জাদ ও সরোয়ার ভাইসহ প্রায় ৪০-৫০ জন আহত হন। মাথা ও পায়ে গুলি বিদ্ধ হয়ে শহীদ আবিদ বিন ইসলাম ভাই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। ওখান থেকে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও পুলিশ বাহিনী আমার ভাইয়ের চোখ উপড়ে ফেলে। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক হয়ে পড়লে ডবলমুরিং থানা পুলিশ চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। হাসপাতালে পৌঁছলে কর্তব্যরত ডাক্তার শহীদ আবিদ বিন ইসলাম ভাইকে মৃত ঘোষণা করেন। শহীদের পিতা-মাতার আদরের সন্তান হারিয়ে পরিবারে যেন খাঁ খাঁ করছে। সে চিরচেনা স্বর আর পড়ার টেবিলে পড়া মুখস্থ করেন না। ভোর বিহানে বাবা ও বড় ভাইকে সাথে নিয়ে নামাজ পড়বেন না এবং সঙ্গী সাথীদের কুরআন হাদিসের কথা এবং নামাজ রোজার কথা আর কখনো তিনি বলবেন না। তিনি এখন শাহাদতের অমিয় পিয়ালা পান করে জান্নাতের মেহমান হয়ে চিরনিদ্রায় আল্লাহর দরবারে পাড়ি জমিয়েছেন। আমার প্রিয় আবিদ বিন ইসলামের শাহাদতের কথা শোনামাত্র চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারিনি। তিনি প্রতিবেশীদের একজন অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় হিসেবে সবার কাছে প্রিয় ছিলেন। আমি শহীদের গর্বিত পিতা-মাতা, প্রতিবেশী ও দায়িত্বশীলের কাছ থেকে জানতে পারলাম তিনি কোন সময় কাউকে গালমন্দ কিংবা কটু কথা বলতেন না। তিনি বাস্তবে ছিলেন একজন খোদাভীরু, সৎ, নিষ্ঠাবান ও সৎচরিত্রের অধিকারী। এমন আমল ও আখলাক মহান আল্লাহতায়ালা যুগে যুগে তাঁর জান্নাতি বান্দাদের মাঝেই কেবল দান করেন। তিনি সর্বদা মন্দের জবাব ভালো দিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতেন। তাই বলে তিনি বাতিলের কাছে হকের বিসর্জন দিতেন না। শহীদ আবিদ বিন ইসলাম এদেশের মানবতার জন্য এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। কিন্তু তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। আছে শুধু তার রেখে যাওয়া অজস্র স্মৃতির ভাণ্ডার। আমাদের প্রিয় ভাইকে যারা শহীদ করেছে দুনিয়াতে হয়তোবা তাদের বিচার হবে না। কিন্তু তাদেরকে আল্লাহতায়ালা অবশ্যই আখিরাতের আদালতে বিচারের সম্মুখীন করবেনই করবেন।
চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপ উপজেলার মা-বাবার অপরিমেয় আদরে লালিত ছেলে শহীদ আবিদ বিন ইসলাম। শহীদ আবিদ বিন ইসলাম এমন প্রকৃতির ছিলেন যখনই তাকে কোন সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত দেয়া হতো, সাথে সাথে তা হাসিমুখে মেনে নিতেন। সবার আগে কিভাবে কাজটি শেষ করা যায় এই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতেন। সময়মতো সকল কাজে তিনি উপস্থিত হতেন, এমনকি প্রত্যেকটি মিছিলেও।
ইসলামী ছাত্রশিবিরের জনশক্তিদের কাছে শহীদের পিতার প্রত্যাশা ইসলামী আন্দোলনকে বেগবান করা,শহীদ আবিদ বিন ইসলামের রেখে যাওয়া কাজ শেষ করা এবং জামায়াত- শিবিরের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের মুক্তির আন্দোলনের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাবে। শহীদ আবিদ বিন ইসলাম সবাইকে ডিঙিয়ে আমাদেরকে পেছনে ফেলে চলে গেলেন সামনে। মহান আল্লাহতায়ালা তাকে শাহাদতের সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করুন এবং আমাদের সকলকেই শহীদি প্রেরণা নিয়ে দ্বীন কায়েমের প্রচেষ্টায় সম্পৃক্ত থাকার তৌফিক দিন আমিন।
লেখক : প্রকাশনা সম্পাদক
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির
চট্টগ্রাম মহানগরী দক্ষিণ
৫ই ফেব্রুয়ারী, ২০১৫ । ২০১৩ সালের ঠিক এই দিনেই চট্টগ্রামে বাতিলের আঘাতে শাহাদাত বরণ করেন "শহীদ আবিদ বিন ইসলাম" সহ আরো তিন জন ভাই ।
# কি ঘটেছিল সেদিন ???
দিনটি ছিল ৫ই ফেব্রুয়ারী, ২০১৩ । মানবতাবিরোধী অপরাধের নামে সাজানো নাটক মঞ্চস্থকারী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম সীপাহসালার "শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা" সাহেবের বিরুদ্ধে দেয়া যাবজ্জীবন রায়ের প্রতিবাদে সারা দেশের ন্যায় ইসলামী ছাত্রশিবির চট্টগ্রাম মহানগরী দক্ষিণ দুপুর ১ টায় অলংকার মোড়ে প্রতিবাদ মিছিল বের করে । মিছিলের শুরুতেই পুলিশ-RAB এর মুহুর্মুহু গুলিতে শাহাদাত বরণ করেন শিবিরের সাথী প্রিয় ভাই "শহীদ ইমরান খান" । "শহীদ আবিদ বিন ইসলাম"ও সাইকেল যোগে এই মিছিলে অংশ নিয়েছিল । দায়িত্বশীলের নির্দেশে বাসায় গিয়ে খাবার গ্রহণের সময় আবীদের মা ইমরানের মায়ের কথা ভেবে আবীদকে বললেন “না জানি ইমরানের আম্মু এখন কেমন আছে" - আবিদের আম্মু তখনো জানতেননা কিছুক্ষণ পর সন্ধ্যায় ইমরানের আম্মুর মতো তার বুকের মানিকও তাকে ছেড়ে ইমরানের মতো চলে যাবে ।
# প্রভুর সান্নিধ্যে ফিরে যাবার ক্ষণ !!!
৫ই ফেব্রুয়ারী, ২০১৩ । সন্ধ্যার পর শাহাদাতের প্রতিবাদে মিছিল হবে । কোরআন যাদের বুকে, শাহাদাত যাদের কাম্য, তারা কি মিছিলে না এসে বাসায় বসে থাকতে পারে ??? তাইতো আবিদও পারেনি । এইচএসসি পরীক্ষার্থী হওয়ায় সাংগঠনিকভাবে ছুটিতে থাকলেও সে মিছিলে এসে সামনের কাতারেই অংশ নেয় । মিছিল শুরু হতেই পুলিশের মুহুর্মুহু গুলিতে শাহাদাত বরণ করেন জামায়াতের দুই কর্মী আফজাল ও শফীক । পুলিশ সম্পূর্ন সুস্থ আবীদকে গ্রেপ্তার করে ভ্যানে তুলে বুকে গুলি করে, পরে ভ্যানের মধ্যেই পুলিশ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা আবীদের দুইচোখ উপড়ে ফেলে । এর পর শহীদ আবীদকে তারা চট্টগ্রাম মেডিকেলের মর্গে পাঠিয়ে দেয়। এদিকে সন্ধ্যায় আবীদের খোঁজে বাবা ও তার আত্মীয়স্বজন থানায় যোগাযোগ করলেও ওনাদেরকে কোনো তথ্য দেয়া হয়নি । পরন্তু কোনো উপায় না পেয়ে আনুমানিক রাত ১০টায় আবিদের আব্বু সহ অন্য আত্মীয় স্বজনরা মেডিকেলের মর্গে আবিদের দুচোখ উপড়ানো ও বুকে গুলিবিদ্ধ লাশ দেখতে পান ।
এভাবে সতীর্থদের সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে মিছিলের সম্মুখে থাকা সদা চঞ্চল হাস্যোজ্জ্বল আবীদ চলে গেলেন না ফেরার দেশে ।
## কিছু সৃতি আবেগের !! কিছু তথ্য শুধুই অনুপ্রেরণার !!!
# আবিদের আব্বু বলেছেন :
"আমি যতোবারই তার উপর বিভিন্ন কারণে রাগ করে তাকে বকা দিতে গিয়েছি যখনই তার দুচোখে আমার চোখ পড়েছে তখনই আমার রাগ গলে পানি হয়ে গিয়েছে । তার চোখ ছিল মায়া আর ভালবাসার প্রদীপ । ওই দু’চোখে যার চোখ একবার পড়বে সে কখনোই তার শত্রু হতে পারবেনা ।"
# মা বললেন, "এজন্যেই পুলিশ আর ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে তার চোখ উপড়ে ফেলে । কারণ তারা তার চোখের জ্যোতিকে সহ্য করতে পারতোনা । দুচোখ দিয়ে সে একবার যাকে একটি মুহূর্তের জন্যে দেখেছে তাকে কখনোই ভুলতোনা । চোখতো নয় যেন হরিণের দৃষ্টি।"
# শাহাদাত বরণের কয়েকদিন আগে তার লেখা কবিতার নাম “মানবতাঃ"
"মানবতা শুধু তোমাদের জন্য নয়
মানবতা সবসময় নিরপেক্ষ হয়।
মানবতা কোনো গোষ্ঠির জন্য নয়
বরং মানবতা মজলুমের কথা কয়।
আজ দেশে দেশে শুনি মুসলমানদের প্রতি নির্যাতন
আর মানবতা হয়ে গেল তাদের জন্য অসহায় অবচেতন
তোমরাই বল মানবতা ! তোমরাই বলো মানবাধিকার !
অথচ দেখো ফিলিস্তীনের শিশুরা করে হাহাকার ।
যুদ্ধের পর যুদ্ধ করো তোমরা
আর জঙ্গী হয় মুসলমানেরা ।
একি মানবতা ! একি মানবতা !"
# "মা কেনো তাহাজ্জুত পড়ছোনা" ???
রাতজাগা এই পাখি মাঝে মাঝে একা তাহাজ্জুত পড়তো । এদিকে মা তো সারাক্ষণ কাজে ব্যস্ত থাকতো, একদিন অধিক রাত অবধি মা তার কাজ করে চলছেন তখন ছোটো ছেলে আবিদ গিয়ে গম্ভির স্বরে মাকে বললো “মা কেনো তাহাজ্জুদ পড়ছোনা.. এটাতো তাহাজ্জুদের সময়"। মূহুর্তেই মায়ের মনে হলো আবিদ যেনো ওনাকে দ্বীন শেখাচ্ছে । ছোট শিশু যখন এভাবে মা-বাবার শিক্ষক হন তখন মা-বাবার মনে আনন্দের সমীরন বয়ে যায় । এখন গভীর রাতে আবিদকে মা অনেক বেশী অনুভব করেন আর দুহাত তুলো জান্নাতের পাখি আবিদের জন্য দোয়া করেন ।
# "এটা ভবিষ্যতের ব্যারিষ্টার আবিদ বিন ইসলামের চেয়ার" !!!
একদিন হঠাৎ আব্বুর চেম্বারে এসে আবিদ বললো : "আব্বু ! চেয়ার থেকে ওঠো", কি আর করা, জো হুকুম জাহাপনা : আব্বু চেয়ার থেকে উঠামাত্র সে আব্বুর চেয়ারে বসে বললো : এটা ভবিষ্যতের ব্যারিষ্টার আবিদ বিন ইসলামের চেয়ার । আব্বুর স্বপ্ন ছিল আবিদ ব্যারিষ্টার হবে । দাদা ছিলেন কৃষক। কৃষকের ছেলে যদি স্বনামধন্য এডভোকেট হতে পারেন তবে তার ছেলেকে অবশ্যই ব্যারিষ্টার হতে হবে ।
# একদিনের ঘটনা !!!
''রাত ১ টা বাজে, কত্তবড় বেয়াদব ! এখনো বাসায় ফেরেনি !! গেল কোথায় ছেলেটা ! ''এদিকে আবিদের দেরি দেখে আব্বুরতো মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সিদ্ধান্ত নিলেন আজ ইচ্ছা মত পেটাবেন । পুরানো বেতটা খুজে বের করে তৈরী হয়ে থাকলেন । রাত একটার পরে আবিদ বাসায় ফিরলো । বাবা চোখ গরম করে বেত উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ''কই ছিলি এতোক্ষণ ?'' আবিদ জবাব দিয়েছিল, '' উপশাখার শুভাকাঙ্খির কাছে গিয়েছিলাম । আজ এসময়ে তার কাছে না গেলে বাইতুল মালের টাকাটা এমাসে আর পেতাম না ।'' ছেলের এমন সোজাসাফটা জবাবে মুনির সাহেব থমকে গেলেন ! না,না । এমন হীরের টুকরা ছেলেকে শাস্তি দেয়া যায়না ।
# ২০১২সালের ২১ এ ডিসেম্বর আবিদ তার ডায়েরিতে লিখলো,
“আমার মনের সকল আশা পূরণ হবেনা
এমন করে চলে যাবো কেউতো বুঝবেনা”
# শাহাদাতের পর দায়িত্বশীলরা দেখা করতে গেলে আবিদের আম্মু-আব্বু এমন আদর করে বুকে জড়িয়ে নিলেন যেন তাদের আবিদ ঘরে ফিরে এসেছে । চোখ দিয়ে যখন অশ্রু ঝরছিল তখন আব্বু বললেন, "আমার আবিদ তোমাদের কাঁদতে শেখায়নি । জালিমের কারাগার ভেঙ্গে আল্লামা সাঈদী সহ নের্তবৃন্দকে মুক্তকরে আনো তাহলে আমাদের আবিদের আত্মা শান্তি পাবে"।
কতটুকু পেরেছি জানিনা । তবে আমরা একটি মুহূর্তও বসে থাকতে রাজি নই ।
আবিদসহ সকল শহীদের রক্তের বদলা নেবার শপথে মাঠে ময়দানে জীবন উৎসর্গ করার প্রত্যয়ে নামতে আমরা দীপ্ত প্রতিজ্ঞাবদ্ধ । বাতিলের সময়োপযোগি ও দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ । হয় আন্দোলন ও সংগ্রামের মাধ্যমে দ্বীন ইসলামকে আমরা বিজয়ী করবো ইনশাআল্লাহ, নয়তো এই কাজে আমাদের জীবন শেষ হয়ে যাবে ।
১৯৯৫ সালের ৩১ মার্চ শুক্রবার জুমার নামাজে যাবো-কি যাব না এমন অবস্থায় কাছের মসজিদ থেকে নামাজ শেষ করেই ঘরে এসে দেখি প্রশান্ত মায়ের পাশেই অসম্ভব মায়াময় একখানা মুখ। আমাকে দেখে তার মা-ও হাসল। আমি আলহামদুলিল্লাহ পড়ে তার পাশে বসলাম। আমার প্রাণে এমন আনন্দের ঢেউ খেলে গেল যে আমি তার মাকে না জিজ্ঞেস করেই ধরে নিলাম আমি কন্যাসন্তানের পিতা হলাম। আমাদের উভয়েরই প্রত্যাশা ছিল প্রথম ছেলে, এবার মেয়ে পাবো। পরক্ষণেই তার মায়াময় চেহারার রহস্যের কথা মনে হতেই ভালো করে দেখলাম, নাতো এটাও আগেরটারই ছোট কপি। তার মা বলল এটাও বড়টার মতো দেখেছ? আমি শোকর আদায় করলাম আল্লাহর দান সবই সুন্দর। আলহামদুলিল্লাহ।
বড়টার জন্ম ছিল ১৯৯২ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর। দেখতে মনে হয়েছিল ৩-৪ বছরের বাচ্চা। আর জন্মের সারাটি রাত তার চোখের ওপর আমার চেহারা রাখতে হয়েছিল। সরাতেই কান্না করছিল। কিন্তু আবিদ বেশ দুর্বলই ছিল। জন্মের পর সে বেশ কিছু দিন ঘুমিয়ে কাটিয়েছে।
আমরা অত্যন্ত সংগ্রামের মধ্যেই চলছিলাম। নবজাতকের একটা নাম রাখতে হয়। আগেরটার নাম রাখতে কাউকে ডাকতে পারিনি। পারিবারিক পরিমণ্ডলে, আমার চাচা মাস্টার মৌলভী ফয়জুল মাওলা যিনি আজকের আবিদকে আবিদ করতে আমাকে অ্যাডভোকেট মনির হওয়ার প্রেরণার উৎস হয়ে আছেন। আমাদের সন্তানদেরকেও সেভাবে মানুষ করার চেষ্টা করেছি, আলহামদুলিল্লাহ। চাচাকে বললাম আগেরটার সাথে মিল রেখে নাম দিতে যাতে শিরক করার সুযোগ না থাকে এমন একটা নাম ঠিক করেন। তিনি আবিদ বলার সাথে সাথেই আমি আলহামদুলিল্লাহ পড়েছি।
কেননা আবিদ শব্দের মূলে আছে আবদ, যার অর্থ বান্দা। বান্দা হওয়ার জন্যই সৃষ্টির আবেদন। আবিদ বিন ইসলাম এই পরিচয়ের জন্য একটু ইতিহাসে যেতে হবে। তুর্কিস্তানের কোন এক উপত্যকার সর্দার পুত্র দেলাওয়ার খান। পিতার সঙ্গে মতপার্থক্য হওয়ায় তার সাথী সৈন্যদের নিয়ে ভাগ্যের অম্বেষণে বের হলেন। যাত্রাপথে সবুজ শ্যামল সাগরকন্যা সন্দ্বীপকেই পছন্দ করলেন। সাথীদের নিয়ে নৌবহর ভেড়ালেন সন্দ্বীপে। মগদের দস্যুতায় তখন স্থানীয়রা অতিষ্ঠ ছিলেন। তাই দেলওয়ার খানকে তারা স্বাগত জানালেন এবং মগদের বন্দী হতে হলো দেলওয়ার খানের হাতে।
স্থানটির নাম হয়ে গেল মগধরা। দিলাল রাজার ৪ জন সেনাপতি ছিলেন। একজন আবদুর রশিদ খান দেলোয়ার খান বা দিলাল রাজার ভাগিনা ও কন্যা মুছা বিবির জামাতা দ্বিতীয় বাহাদুর খান এবং আদিল খানসহ নাম না জানা অনেকে। সুবেদার ইসলাম পরবর্তীতে আবদুর রশিদ খানকে হাত করে দেলোয়ার খানকে পরাজিত ও বন্দী করেন।
বাকেরগঞ্জের কিছু অঞ্চল, কোম্পানীগঞ্জ ও আরাকানের সীমানা ভেঙে সন্দ্বীপ পরগনাভুক্ত করে মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। আবদুর রশিদ খানের অধস্তন পুরুষদের একজন হলেন চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি মাহবুব উদ্দিন আহমদ, বর্তমানে বাঁশখালীর অধিবাসী।
দানী বাহাদুর খানের অধস্তন পুরুষরা ইজ্জতপুর এলাকায় কয়েকটি বাড়ি করে বসবাস করেছেন। নদীভাঙনে এখন তারা বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছেন। দানী বাহাদুরের অধস্তন পুরুষ আজিম মাঝি। যার জাহাজের কারবার ছিল।
কোন এক সমুদ্রঝড়ে তিনি নিহত হলে তার দুই পুত্র খবির উদ্দিন ও আবদুল বারী অসহায় হয়ে পড়েন। ছোট ভাই আবদুল বারীকে অন্যত্র লালন পালনের জন্য দিয়ে সহায় সম্পদ খরচ করে তিনি মাওলানা হন। পরে তারাখাঁর বংশের মেয়ে মাওলানা ওয়াজিউল্যাহর বোনকে বিয়ে করেন। স্ত্রী এক কন্যাসন্তান জন্ম দানের সময় মৃত্যুবরণ করেন। কয়দিন পর ঐ কন্যারও মৃত্যু হলে তিনি স্ত্রী ও কন্যার সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী হন। ভ্রাতা আবদুল বারিককে তার প্রাপ্য অংশে সমান ভাগ দেন এবং শ্বশুরবাড়ির পাশে বাড়ি করেন। মৌলভী খবির উদ্দীনের বড় মেয়ের ছেলে হেডমাস্টার এম এ মজিবুল হক, পুত্র ফজলুল করিম ১৯৭৩ সালে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যোগদান করেন। তার পুত্রগণের মধ্যে আবদুল্লাহ স্কুল শিক্ষক, মোজাফফর সার্কেল অফিসার, ড. সোলাইমান মেহেদী রিয়াদ ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির ইলেকট্রিক্যালের প্রধান ছিলেন, ড. হুমায়ুন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত অবস্থায় রোড এক্সিডেন্টে মারা যান। হিসাম উদ্দিন বাখরাবাদের ইঞ্জনিয়ার। অন্য পুত্রদের মধ্যে নজির আহমদ, আবুল খায়ের, মাহমুদ আলম, ওয়াহিদ মিঞা, ফয়েজ উল্যাহ ও ফয়েজ আহমদ তাদের প্রত্যেক বংশধরগণই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। আবদুল বারীর দুই পুত্র সেরাজুল হক বিদেশী শিপের টেন্ডল ছিলেন। তিনি বাদুরায় লঞ্চডুবিতে মারা যান। মাস্টার ফখরুল ইসলাম সন্দ্বীপ কাঁপানো শিক্ষকদের একজন, তার দুই ছেলে শিপের ক্যাপ্টেন। আবদুল হকের তিন ছেলের মধ্যে জ্যেষ্ঠ শফি উল্যাহ বিদেশী শিপের সুকানি ছিলেন। আমার বাবা নুর উল্যাহ সম্পত্তি ও পরিবারের দেখাশোনা করতেন। চাচা মৌলভী ফয়েজ উল্যাহর কথা আগেই বলেছি, তার বড় ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে সৌদি আরবে কর্মরত আছেন। আমার বড় ভাই বিদেশী শিপের সুকানি হিসেবে কর্মরত থাকাবস্থায় আমেরিকায় পাড়ি দেন, মেজভাই মো: রুহুল আমিন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের এজিএম পদে কর্মরত ছিলেন।
আবিদ বিন ইসলাম কাজেকর্মে আল্লাহর বান্দা হিসেবে তার ছোট জীবন অতিবাহিত করেছে। শৈশবে সে মানুষের সাথে গভীর সম্পর্ক যেমন করেছে তেমনি আল্লাহর সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি করার দৃঢ়প্রত্যয়ে তার কর্মপরিধি ঠিক করে এতদূর এসেছিল। সে কখনও বড়-ছোট, ধনী-গরিব, দল-ধর্ম যাচাই করেনি। হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা দিয়েই আপন করেছিল সমাজের মানুষকে। সেবা করার প্রত্যয়ে কর্মজীবনে একজন নামকরা ব্যারিস্টার হওয়ার স্বপ্ন ছিল তার।
আল্লাহর সন্তুটি অর্জনই ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান। আত্মীয়-স্বজন সবারই খোঁজখবর নেয়া তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল।
শিশুদের মনপ্রাণ উজাড় করে ভালোবাসত। আমার সাথে কথা হতে দেখেছে এমন কাউকে সে আমার পরিচয় দিয়ে বলত আমি অ্যাডভোকেট মনিরের ছেলে, আবিদ বিন ইসলাম। জ্ঞান অর্জনের জন্য সে পাগলপ্রায় ছিল। কুরআন ও হাদিস বোঝার জন্য তার প্রাণান্তকর চেষ্টায় সে গড়ে তুলেছিল নিজস্ব লাইব্রেরি। তার সংগ্রহশালাও কম সমৃদ্ধ নয়।
বিদেশী মুদ্রা ও ডাক টিকেট প্রদর্শনীতে অংশ নেয়ার লক্ষ্যে সে বিভিন্ন দেশের মুদ্রা ও ডাক টিকেট সংগ্রহ করেছে।
ফুলকুঁড়ি আসরের সাথে তার ছিল সুগভীর সম্পর্ক। তাই তার সাথে কবি আল মাহমুদেরও সম্পর্ক ছিল। বিচারপতি আবদুর রউফকে সে দাদু সম্বোধন করত। তার কবিতা লেখার অভ্যাস ছিল । আল্লাহর বন্দনায় সে কবিতা লিখত।
ইসলামী সঙ্গীত তার মুখে মুখে ছিল। যে কোন মোবাইল তার পরিচিত জনরা তাকে দিয়েই মেরামত করত। কম্পিউটার ল্যাপটপ ব্যবহারে তার জুড়ি ছিল না। সার্বক্ষণিক তার কাছে যে কোন খবরের আপডেট থাকত। আমার গল্প ছিল তার কাছে অমৃতের সমান। আর তা থেকেই সে তার নিজের মতো করেই শিক্ষা নিয়েছে।
গত কয়েক বছর পর্যন্ত সে শহীদ হওয়ার কথা দৃঢতার সাথে ব্যক্ত করত। একদিন তার মামীকে বলে, মামী এখন কেউ পাপ না করে থাকতে পারে না। একমাত্র উপায় আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হওয়া। তাহলেই জান্নাতের প্রত্যাশা করা যায়।
সে দিনই শহীদি কাফেলায় শরিক হওয়ার জন্য সে আমার কাছে বলে, ‘আব্বু তুমি আমার জন্য দোয়া কর আমি যেন শহীদ হতে পারি।’ মুখে তাকে কিছু বলতে পারিনি। কিন্তু অন্তর থেকে বলেছিলাম আলহামদুলিল্লাহ।
আর আল্লাহ আমার ছেলের আরজি কবুল করেছেন। আল্লাহর দরবারে লাখ লাখ শুকরিয়া তিনি আমার ছেলের শাহাদাত কবুল করেছেন। আল্লাহ যেন আমার ছেলের অন্তর দিয়ে চাওয়া অভিপ্রায় ইসলামী জিন্দেগি তথা বাস্তবে কুরআন ও সুন্নাহর শাসনব্যবস্থা আমাদেরকে উপহার হিসেবে দেন।
আমিন, আল্লাহুম্মা আমিন।
লেখক : শহীদ আবিদ বিন ইসলামের পিতা
0 comments: