যে অতীত প্রেরনার

আহম্মদ সালমান (শহীদের ভাই এবং শিবিরের কেন্দ্রীয় অর্থ সম্পাদক)


১৭ই আগষ্ট এর ব্যাপারে বক্তব্য বা লেখা লেখির ব্যাপারে আমি কখনই আগ্রহী ছিলাম না। এই আবেগ জড়িত ঘটনাটিকে বার বার এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেছি। তার পরও নিজের অজান্তে একদিন খাতা কলম নিয়ে বসে কিছু লেখার চেষ্টা করলাম। উদ্দেশ্য একটাই শহীদের জীবনের কোন অংশ যদি ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের অনুপ্রানিত করে এই প্রত্যাশায়।

ইসলামী আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ততা ছোটবেলা থেকেই বুজতে শিখেছি। শহীদ আহমদ যায়েদকে আমার বাবা মার পরে আমিই সবচেয়ে কাছ থেকে দেখার সুযোগ বেশী পেয়েছি। কিলাশের সময় ছাড়া বাকী সময়টুকু এক সাথেই কাটাতাম। আমাদের বয়সের ব্যবধান দেড় থেকে দুই বছর হলেও অনেকেই মনে করতেন যমজ ভাই অথবা বন্দু। সময় গুলো বেশ ভালই কেটে যাচ্ছিল। ১৯৯৫ সালে শহীদ ফজলে এলাহীর শাহাদাতের মধ্যদিয়ে লক্ষ্মীপুরে ইসলামী অগ্রযাত্রা এবং শাহাদাতের ধারাবাহিকতা সূচনা হয়।তখন আমি পঞ্চম শ্রেনী এবং শহীদ আহমদ জায়েদ ষষ্ঠ শ্রেনীর ছাত্র।শহীদ ফজলে এলাহীর শাহাদাত আমাদের মত আরো অসংখ কিশোর এর মনে ইসলামী আন্দোলনের লে পরিনত হয়। তার পর থেকে সকল মিছিল মিটিং এ সক্রিয় অংশ গ্রহন করি।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ মতায় আসার পর তাদের একমাত্র লবস্তুতে পরিনত হয় ইসলামী ছাত্রশিবির। লক্ষ্মীপুর জেলায় ও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। তাদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে লক্ষ্মীপুর শহর একমৃত্যু পুরীতে পরিনত হয়। দীর্ঘ ৩ বছরের  অত্যাচার নির্যাতনের প্রতিবাদ করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করে ইসলামী ছাত্রশিবির। ১৯৯৯ সালের ১৫ই আগষ্ঠ দিবাগত রাত ৩.০০ টা লক্ষ্মীপুর শহর সভাপতি, শামছুল ইসলাম ভাই, মিজানুর রহমান মোল্লা ভাই এবং বাহার ভাইকে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীক অপহরনের পর আহত করে এক কবরস্থানে ফেলে রেখে যায়। এই ঘটনার পর সকল কর্মীর প্রানের দাবী ছিল ছাত্রলীগের এই সন্ত্রাসের প্রতিবাদ করার ।

১৬ই আগষ্ঠ আমি শহীদ যায়েদ, জাকির, মিঠু ভাই, খোকন ভাই, ফরহাদ সহ স্কুল পর্যায়ের বেশ কিছু কর্মী মহিন ভাইয়ের দোকানে বিকাল বেলা চা খাচ্ছিলাম। এক দায়িত্বশীল এসে খবর দিলেন, আগামীকাল লক্ষ্মীপুর শহরে ছাত্রলীগ এবং তাহের বাহীনির সন্ত্রাসের প্রতিবাদে বিক্ষভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।

সাথে সাথে আমরা সকলে দাড়িয়ে দায়িত্বশীলের কাছ থেকে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করি । তার পর মাগরিবের নামাজ আমরা সকলেই একসাথে আদায় করি । মাগরিবের নামাজের পর শহীদ যায়েদ আমাকে ডেকে বলেন, আমি মিছিলের দাওয়াতী কাজ করার জন্য শহরে যাচ্ছি, তুই বাসায় চলে যায়। বাসায় ফেরার পর লেখা পড়ায়  মন বসছিনা । যায়েদ ভাইয়া রাত ৯.৩০ মিনিটে বাসায় ফিরেছেন । পরের দিন আমরা চার ভাই ফজরের নামাজ আদায় করে বাসায় ফিরে গোসল করে মিছিলে যাওয়ার প্রস্তুতি শেষ করি ।

সকাল ৭.৩০ মিনিট দারুল আমান একাডেমী মসজিদে মিছিল পূর্ব সমাবেশে সকলে একত্রিত হই। আমার নানা মরহুম সফিক উল্লাহ  আবেগময়ী বক্তব্য রাখেন। জেলা সভাপতি মিছিলে তিনটি গ্রুপের নাম ঘোষনা করেন। কোন গ্রুপেই স্কুল কর্মীদের নাম ঘোষনা করা হয়নি। এবং সর্বশেষ স্কুল কর্মীদেরকে মিছিলে না নেওয়ার ব্যাপারে সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত জানান। তার পর আমরা স্কুল পর্যায়ের সকল কর্মীদের একত্রিত করে সিদ্ধান্ত নিই,আমরা যে ভাবেই হোক মিছিলে অংশ গ্রহন করবো।

আমাদের সাথে স্টেশনের সোহেল ভাই , কবির মামা এবং সওদাগর বাড়ীর জোবায়ের মামা সহ আরো অনেকেই অংশ গ্রহন করেন।

আমাদের আলাপ চারিতার এক পর্যায়ে শহীদ আহমদ জায়েদ কোন সংকোচ ছাড়াই বললেন , আমাদের মধ্য থেকে যদি অন্তত একজনকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন শহীদ হিসেবে কবুল করতেরন, তাহলে কতইনা ভাল হত। তার এই কথাটি তখন আমরা অনেকেই গুরুত্ব দিয়ে শুনিনি।তার পরের ঘটনা সকলেরই জানা। তাহের বাহিনীর নির্মম,নিষ্ঠুর ,পৈশাচিকতার শিকারে পরিনত হন শহীদ আহমদ জায়েদ । সবচেয়ে দুঃখ জনক ঘটনা হল , তার জানাযার নামাজটিকে ও তারা পন্ড করার জন্য হামলা চালায়। যা লক্ষ্মীপুরের সর্ব স্তরের মানুষকে হতবাক করেছে।

শহীদ আহমদ জায়েদের শাহাদাতের পর দুইটি ঘটনা আমার এখন ও মনে পড়ে। ১৯৯৯ সালে মার্চ অথবা এপ্রিল মাসে আমাদের ডাইনিং রুমে এক জরুরী সভা বসে । সেখানে লক্ষ্মীপুরের  সাবেক  জেলা সভাপতি আ.ন.ম.আবুল খায়ের ভাই, নুর নবী ফারুক ভাই, মিজানুর রহমান মোল্লা ভাই সহ আরও কিছু দায়িত্বশীল ছিলেন। যাদের কথায় এক পর্যায়ে একজন ভাই বললেন, লক্ষ্মীপুরের স্বাভাবিক পরিস্থিতির জন্য আমাদের দুই থেকে তিনজন ভাইকে হারাতে হতে পারে। সেদিন আমি আর জায়েদ ভাইয়া একসাথে বসেই পর্দার আড়াল থেকে কথাটি শুনেছিলাম। কিন্তু এই কথাটি আমার মধ্যে কোন পরিবর্তন আনতে না পারলেও শহীদ জায়েদের মধ্যে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দেয়। আমার মনে হয় তখন থেকেই শহীদি মিছিলে নিজের নাম লেখাবার জন্য সে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তার এই তীব্র আকাঙ্খা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কবুল করেছেন।

আমি মাঝে মাঝে অদ্ভুত কিছু স্বপ্ন দেখি; যা পরবর্তীতে বাস্তবতায় রূপ নেয়। ১৯৯৭ সালে রমজান মাসে সেহরীর পর আমি একটি স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন ছিল বাতিলের সাথে সংঘর্ষে জায়েদ ভাইয়া নিহত হয়েছেন। তখনই আমার ঘুম ভেঙ্গে যায় এবং আমি শুয়ে শুয়ে অনেকক্ষণ কেঁদেছি। আমার এই স্বপ্নটি ১৯৯৯ সালে ১৭ই আগষ্ট যে ভাবে বাস্তবে রূপ নিবে এটি আমি চিন্তা অথবা প্রত্যাশা কোনটিই করিনি।

আসহাবে রাসুল(সঃ) এবং ইসলামী আন্দোলনের সকল শহীদদের মাঝে একটি চমৎকার মিল খুজে পেয়েছি। আর তা হল, ইসলামী আন্দোলনের কাজকে জীবনের সকল কাজের উপর প্রাধান্য দেয়া, পৃথিবীর আর কোন শক্তি থামাতে পারেনি।

অগুছালোভাবে অনেকগুলো কথা লিখেছি। এর পূর্বে আমার লেখার কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। সর্বশেষ যেটা বলতে চাই, লক্ষ্মীপুরের সবুজ প্রান্তরকে রঙ্গিন করেছে। আমাদের চারজন শহীদের রক্ত। এই রক্ত কখনই বৃথা যাবে না। এই রক্ত লক্ষ্মীপুরের জমিনকে উর্বর  করেছে। ইসলামী আন্দোলনের পিচ্ছিল পথকে করেছে কোমল। এই শহীদ ভায়েরা আমাদের অনেক দায়বদ্ধতার মধ্যে ফেলেছেন। আমরা যদি শাহাদাতের তামান্না নিয়ে এই ময়দানে সাহসীকতার সাথে ভূমিকা পালন করতে পারি, তাহলে শহীদের রক্তের প্রতিটি ফোটা একদিন কথা বলবে। বাংলাদেশের ইসলামী বিপ্লবের সূচনা এই লক্ষ্মীপুর থেকে শুরু হবে। লাল সবুজের পতাকার পাশে কালেমার পতাকা একদিন উড়বেই ইনশাআল্লাহ।