ফাঁসির মঞ্চে ওঠানোর দুজনকে ওঠানো আগে তওবা পড়ান ইমাম মনির হোসেন। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী তওবা পড়লেও মুজাহিদ বলেন, ‘তওবা পড়তে হবে না। আমি দোয়া পড়েছি।’ এর আগে যম টুপি পরিয়ে কারাগারের নিজ নিজ কক্ষ থেকে বের করা হয় দুজনকে।
প্রাণভিক্ষা চাওয়ার খবর মিথ্যাচার: মুজাহিদ
আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ বলেছেন, রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার খবর সম্পূর্ণ মিথ্যাচার।
রাতে মুজাহিদের সঙ্গে কারাগারে শেষ সাক্ষাত শেষে তার ছেলে আলী আহমদ মাবরুর গণমাধ্যমকে এতথ্য জানান।
তিনি জানান, তার বাবা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ তাকে বলেছেন, তিনি প্রাণভিক্ষা চাননি। ওনার (মুজাহিদ) সম্পর্কে প্রশাসন মিথ্যাচার করেছে। বিগত পাঁচটা বছর ওনার (মুজাহিদ) নামে মিথ্যাচার করে মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। আজ তার জীবনের শেষ সময়ে এসেও তার বিষয়ে (প্রাণভিক্ষা) মিথ্যাচার করা হয়েছে।
আলী আহমদ মাবরুর বলেন, তিনি (মুজাহিদ) কোন মার্সি পিটিশন করেননি। দেশের কাছে, দলের কাছে, পরিবারের কাছে হেয় করা ও কাপুরুষ বানানোর জন্য এই মিথ্যাচারের নাটক তৈরি করা হয়েছে।
যেভাবে কার্যকর করা হলো ফাঁসি!
একই সময় একই মঞ্চে জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ও বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়।রোরবার (শনিবার দিবাগত রাত) রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়।
রাত সাড়ে আটটার দিকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও মুজাহিদকে গোসল করানো হয়। ৯ থেকে সাড়ে ৯টার মধ্যে দেওয়া হয় রাতের খাবার। খাবারের মেন্যু ছিলো মুরগি, ডাল ও সবজি। তখন সালাউদ্দিন খেলেও মুজাহিদ খাননি। ৯টা ৩৫ মিনিটে শেষবারের মতো দেখা করতে কারাগারে ঢোকেন সাকার পরিবারের সদস্যরা। তারা অবস্থান করেন ১০টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত। সালাউদ্দিন কাদেরের পরিবার বের হলে ঢোকেন মুজাহিদের পরিবারের সদস্যরা। তারা অবস্থান করেন সোয়া ১২টা পর্যন্ত।
১২টা ৩৬ মিনিটে কনডেম সেল থেকে যমটুপি পরিয়ে দু’জনকে একসঙ্গে ফাঁসির মঞ্চে নেওয়া হয়। এসময় তাদের মধ্যে কোনো রিঅ্যাকশন ছিলো না।
তাদের দাঁড় করানো হয় একই মঞ্চে পাশাপাশি। একই সঙ্গে দু’জনের ফাঁসি কার্যকর করেন জল্লাদ শাজাহান ও রাজু। পরে কারা চিকিৎসক ডা. বিপ্লব কুমার ও আহসান হাবিব, ঢাকা জেলার সিভিল সার্জন আবদুল মালেকের তত্ত্বাবধানে ময়নাতদন্ত হয়। এসময় শুধু তাদের ঘাড়ের রগ কাটা হয়। কারাগারের দায়িত্বশীল সূত্র এসব তথ্য জানা গেছে।
সালাউদ্দিন কাদের দোষ স্বীকার করেননি, প্রাণভিক্ষাও চাননি
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ‘দোষ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন’ মর্মে গণমাধ্যমে যে খবর প্রচারিত হচ্ছে তা অসত্য। বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্যই এমন খবর প্রচার করা হয়েছিল।
ড. আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিবারের সদস্যরা রাতে তার সঙ্গে সর্বশেষ সাক্ষাৎ করে দলকে অবহিত করেছেন যে, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী দোষ স্বীকার করেন নি। রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে প্রাণভিক্ষাও চাননি।
তার পরিবার বিএনপিকে অবহিত করেছেন এ মর্মে একটি বিভ্রান্তি ছড়ানোর অপপ্রয়াস চলছে, যা আদৌ সত্য নয়।
তার পরিবার দলকে আরো অবহিত করেছেন যে অভিযোগে তাকে প্রাণদন্ড- দেয়া হয়েছে, এ ধরনের কোন অপরাধ তিনি করেননি যা তিনি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে আদালতেও যুক্তি ও দালিলিক প্রমাণ দাখিল করেছিলেন। কিন্তু তিনি ন্যায় বিচার পাননি।
তার পরিবার দলকে আরো জানিয়েছেন তিনি নিশ্চয়ই পরম করুণাময় আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে ন্যায় বিচার লাভ করবেন।
প্রাণভিক্ষা চান নি সালাউদ্দিন কাদের : সাক্ষাৎ শেষে জানালেন তার ছেলে
মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শেষ দেখা করার সময় সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের অভিযোগ এনেছেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী।
তিনি বলেছেন, ‘সরকারতো কত কিছুই বানাবে, কত কাগজ তৈরি করবে।’ কারাগারের ভেতরে দেখা করে আসার পর উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে এ কথা বলেন সাকা চৌধুরীর বড় ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী।
হুম্মাম বলেন, আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করেছি প্রাণ ভিক্ষার আবেদন করেছেন কি না। জবাবে তিনি বলেছেন, ‘কে বলেছে এমন বাজে কথা।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমি যখন বাবাকে বলি সরকার বলছে এ কথা। উত্তরে তিনি বলেন, নির্বাচনে তাকে হারাতে না পেরে এখন তার প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে।’ এর আগে রাত সাড়ে নয়টার পরপরই কারাগারে শেষ দেখা করতে ঢোকে সাকা চৌধুরীর পরিবার। রাত পৌনে ১১টার দিকে তারা বের হয়ে আসেন।
****
বাবার সঙ্গে শেষ কী কথা হয়েছিল জানতে চাইলে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছোট ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী বলেন, “বাবা বলেছেন, তিনি প্রাণভিক্ষা চাননি। আমি বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বাবা তুমি কি প্রাণভিক্ষা চেয়েছো? তখন বাবা বলেন, ‘কে বলেছে এসব ফালতু কথা? তোমার বাবা কখনো মাথা নত করার মানুষ নন। তোমার বাবা প্রাণভিক্ষা চাইবে তুমি বিশ্বাস করলে কীভাবে?
আমি তো এখন নাই। আওয়ামী লীগ কত কাগজ বের করবে। আমাকে জীবনে কখনো হারাতে না পেরে আমার জান নিয়ে প্রতিশোধ নিয়েছে আওয়ামী লীগ’।”
হুম্মাম কাদের চৌধুরী আরো বলেন, ‘শেষ মুহূর্তে আমরা দুই ভাই বাবাকে জড়িয়ে যখন কান্না করছিলাম তখন বাবা আমাদের বলেন, ‘তোমরা অনেক ভাগ্যবান যে দেশের এমন পরিস্থিতিতে অনেকে খুন-গুম হচ্ছে। অনেকে আপনজনের মরদেহ খুঁজে পাচ্ছে না। তোমরা ভাগ্যবান যে সম্মানের সঙ্গে আমাকে দাফন করতে পারবে’।
হুম্মাম বলেন, ‘বাবা আমাকে বলেন, তোমার মাকে দেখো হুম্মাম।’
এরপর স্ত্রী ফারহাত কাদের চৌধুরীর সঙ্গে একান্তে কিছু সময় কথা বলেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। এ কথা জানিয়ে হুম্মাম কাদের বলেন, “এ সময় আমার মা অনেক আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। তখন মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বাবা বলেন, ‘আল্লাহর কাছে একদিন ন্যায়বিচার পাব। কেয়ামতের মাঠে দেখা হবে। দেশের মানুষ অবশ্যই একদিন ন্যায়বিচারের ডাক দেবে’।”
সাকা চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করার পর হুম্মাম বলেন, ‘বাবা বলেছেন তিনি কোনো কাগজে স্বাক্ষর করেননি। তিনি বলেছেন, যে কাগজ বের হয়েছে, এ ধরনের কাগজ আরো কত দেখবে সামনে। তিনি আরো বলেছেন, নির্বাচনে হারাতে পারেনি তাই একটু পর তার জান নিয়ে নেওয়া হবে।’
****
প্রাণভিক্ষা চাওয়ার বিষয়টি অসত্যঃ মুজাহিদের ছেলে আলী আহম্মদ মাবরুর।
‘প্রাণভিক্ষা চাওয়ার বিষয়টি ভিত্তিহীন, বোগাস এবং প্রশাসনের একটি সাজানো নাটক। মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আগে কারাগারে বাবা (মুজাহিদ) জানিয়েছেন তিনি কোনো মার্সি পিটিশন করেননি।’
কারাগারে মাবরুরকে উদ্দেশ্যে করে মুজাহিদ বলেন, ‘এ জালিম সরকারের কাছে আমার প্রাণভিক্ষা চাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এই সরকার গত ৫ বছর আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগে মিথ্যা মামলা দিয়ে মিথ্যাচার করেছে। আজ এই শেষ মুহূর্তে এসেও তারা মিথ্যাচার অব্যাহত রেখেছে। মূলত আমাকে আমার দলের কাছে, আমার পরিবারের কাছে, দেশের মানুষের কাছে হেয় করার জন্য কাপুরুষ বানানোর জন্য তারা এ মিথ্য অপপ্রচারের নাটক করেছে।’
ফাঁসির আগ মুহূর্তে সা. কাদের-মুজাহিদ
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ পাশাপাশি কনডেম সেলে ছিলেন। রাত ১২টা ৪০ মিনিটে দুজন ম্যাজিস্ট্রেট কনডেম সেলে যান।
আশরাফ হোসেন ও তানভীর মাহামুদ নামের দুজন ম্যাজিস্ট্রেট তাদের দুজনকে বের করে আনেন। কারাগার মসজিদের পেশ ইমাম মনির হোসেন তাদের দুজনকেই তওবা পড়াতে যান।
ফাঁসির আগে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, আমি কোনো অন্যায় করিনি। ঈর্ষান্বিত হয়ে শেখ হাসিনা আমাকে ফাঁসিতে ঝোলাচ্ছে। তার বিচার আল্লাহ করবে।
রাত ১২টা ৪০ মিনিট থেকে ৪৫ মিনিটের দিকে তাদের দুজনকে কনডেম সেল থেকে বের করা হয়।
মুজাহিদ বলেন, ‘আমি কোনো অন্যায় করিনি। এর বিচার আল্লাহ করবে।’ ১২টা ৫০ থেকে ৫১ মিনিটে তাঁদের দুজনকে ফাঁসির মঞ্চে নেওয়া হয়। ফাঁসির মঞ্চের লিভারের দায়িত্বে ছিলেন জল্লাদ শাহজাহান। মুজাহিদ প্রথমে জমটুপি পরতে চাননি।
তিনি বলেছেন, ‘আমার কোনো অসুবিধা হবে না। জমটুপি পরাতে হবে না।’ কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষ তাকে বলে, রীতি অনুযায়ী তাঁকে জমটুপি পরতেই হবে। পরে তিনি জমটুপি পরেন।
ফাঁসির কাষ্ঠে ওঠার আগে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও মুজাহিদ দুজনই কোরআন তেলাওয়াত, কলেমাসহ বিভিন্ন দোয়া-দরুদ পড়তে থাকেন। মঞ্চে ওঠার আগে তারা দুজনে অজু করেন। দুই রাকাত নফল নামাজ পড়েন। রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
ডিবির উপপরিদর্শক নাজমুল আলম জানান, তাদের দুজনকে একই মঞ্চে একই লিভারে ফাঁসি দেওয়া হয়। এ সময় তারা দুজনই স্বাভাবিক ছিলেন। ফাঁসি কার্যকরের সময় তারা দুজনই চিৎকার করে ওঠেন। ১৫ মিনিটের মতো তাদের ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এরপর নামিয়ে এনে পায়ের রগ কেটে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়।
রাত ২টা ৫৫ মিনিটে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর কফিনবাহী একটি অ্যাম্বুলেন্স বের হয়ে আসে এবং র্যাব-পুলিশের পাহারায় তার গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজানের উদ্দেশে রওনা হয়ে যায়। এর পরপরই মুজাহিদের কফিনবাহী অ্যাম্বুলেন্স বের হয়ে আসে এবং তার গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের উদ্দেশে রওনা হয়।
মুজাহিদের শেষ কথাঃ আমার জন্য দোয়া করো, সবাইকে সালাম দিও
********
নিঃশঙ্ক ও দেশপ্রেমিক সালাউদ্দিন কাদের
রাত ৯:২৯। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের বিশাল ফটক। তার মাঝে ছোট্ট দুয়ার। গুণে গুণে ১৭ জন ভেতরে ঢুকলেন। ফাঁসির আসামির স্বজন তারা। স্ত্রী, ছেলে, মেয়েসহ নিকটাত্মীয়।
কারাগারে ভেতরে ঢুকতেই হাতের বায়ে ফাঁসি মঞ্চ। তার ১০-১২ গজ দূরে একটা খোপঘর। কেতাবি ভাষায় কনডেম সেল। ৬ নম্বর কনডেম সেলটা বড়জোর ৭ বর্গফুট। একটা দরজা। ফ্যান নাই। ছোট্ট ভ্যান্টিলেটর দিয়ে শ্বাস টানার বাতাসের যাতায়াত।
বিষ্যুৎবারও এখানেই দেখা হয়েছিল। শনিবার রাতে আসতে হল শেষবারের জন্য। প্রথমেই কথা হলো বাইরের পরিস্থিতি নিয়ে। রটে গেছে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী যুদ্ধাপরাধের দায় স্বীকার করে প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছেন। আবেদন করেছেন আবুদল হামিদ অ্যাডভোকেট বরাবর। জাতীয় সংসদে সালাউদ্দিন কাদেরে সাবেক সহকর্মী এখন রাষ্ট্রপতি।
কিন্তু চতুর্থ থেকে অষ্টম সংসদের টানা ছয়বারের সাংসদ সালাউদ্দিন মৃত্যুর কয়েকঘণ্টা আগেও আগের মতো গর্জে উঠলেন। “এই বাজে কথা তোমাদের কে বলেছে?। আমি কোন আবেদন করিনি। কোন কাগজে সাক্ষর করিনি। যে কাগজ বের হয়েছে, এ ধরনের কাগজ আরো কত দেখবে সামনে।”
এরপর শুরু হলো নিজেদের মধ্যে কথা। শেষ সাক্ষাতে ফাঁসির আসামির সঙ্গে একে একে স্বজনেরা কথা বলে। হাত ধরে। বুকে জড়িয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে। অন্যরাও চোখ মুছে। যার চির বিদায়, তিনিই সবাইকে সান্ত্বনা যোগান। সাহস দেন। দোয়া চান। হাসিমুখে থাকার চেষ্টা করেন।
সালাউদ্দিন কাদের প্রায় পাঁচ বছর ধরে কারাগারে বন্দী। এই সময়টাতে মায়ের নির্দেশনায় সংসার, ব্যবসা, কূটনৈতিক যোগাযোগের সব কিছুই সামলেছেনে ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী।
শেষ দেখায় তিনি বাবার কাছে জানতে চাইলে, “এখন আমরা কি করব?” বাবা দুটি বাক্য উচ্চারণ করলেন, “তোমরা ভাই-বোন এক সঙ্গে থেকো। তোমাদের মাকে দেখে রেখো।”
নিশঙ্ক ও দেশপ্রেমিক সালাউদ্দিন কাদের। বাবা ১৯৪৭ এর স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরী ছিলেন। সমগ্র পাকিস্তানের স্পিকার, ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি। তার ছেলে হিসেবে সব সময় প্রতিপক্ষের টার্গেট ছিলেন তিনি। দশকের পর দশক প্রচারযন্ত্রের লেগেছিল তার পেছনে। তবু যতদিন বেঁচে ছিলেন, বীরোচিত জীবন কাটিয়েছেন।
বিদায়ের আগে স্বজনদের বললেন, “আমার জন্য দোয়া করো। আমি পরকালেও ভালো থাকবো।”
শেষ সাক্ষাতে বড় ভাইয়ের দৃঢ় মানসিকতায় উজ্জীবিত ছোট ভাই জামাল উদ্দিন কাদের চৌধুরীও। তিনি জানালেন, “আমার ভাই একটি কথাই বলেছেন, আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর।”
সাক্ষাৎ শেষে চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেলেন স্বজনরা। এর মধ্যে ছিলেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর স্ত্রী ফারহাত কাদের চৌধুরী, বড় ছেলে ফজলুল কাদের ফাইয়াজ ও পুত্রবধু দানিয়া খন্দকার, ছোট ছেলে হুমমাম কাদের, মেয়ে ফারজিন কাদের ও মেয়েজামাই জাফর খান, ভাই গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামালউদ্দিন কাদের চৌধুরী, ভাবি সেলিনা চৌধুরী ও মাহবুবা চৌধুরী, ভাতিজা ওমর আহমেদ আদেল ও শাকিল কাদের চৌধুরী, দুই বোন জোবেদা মনোয়ার ও হাসিনা কাদের প্রমুখ।
স্বজনদের শেষ সাক্ষাতের আগেই ফাঁসির আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়ে গিয়েছিল। রাত সাড়ে ৮টার দিকে সালাউদ্দিনকে গোছল করানো হয়। এরপর অল্প পরিমাণে খাবার গ্রহণ করেন তিনি। খাবার শেষ হতেই স্বজনরা দেখা করতে চলে আসে। সাক্ষাৎ শেষে তারা কনডেম সেল ছেড়ে যান রাত পৌনে ১১টায়।
এরপর দোয়া পড়তে থাকেন সালাউদ্দিন কাদের। আল্লাহর নাম জিকির করতে বেজে যায় রাত ১২টা। নিরাপত্তা রক্ষীদের সঙ্গে সেলে আসেন কারাগারের জামে মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা মনির হোসেন খান। তিনি তওবা পড়ান সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে।
তওবা পড়ার আগে সালাউদ্দিন কাদের বলেন, “আমি মানবতাবিরোধী কোন অপরাধ করিনি। কিন্তু মানুষ হিসেবে আমার ভুলত্রুটি থাকতে পারে। তাই অন্যায় হত্যার শিকার হওয়ার আগে আমি তওবা পড়তে চাই।”
ইমামের বিদায়ের পর রাত সাড়ে ১২টায় চারজন জল্লাদকে নিয়ে নিরাপত্তা রক্ষীরা ফের সেলে আসে। ১২টা ৩৬ মিনিটে সালাউদ্দিন কাদেরকে যমটুপি পরিয়ে সেল থেকে বের করা হয়। স্বাভাবিকভাবেই ফাঁসির মঞ্চের উদ্দেশে হাঁটতে থাকেন তিনি। কণ্ঠে ছিল মহান আল্লাহর নাম। দোয়া ও কলেমা পড়ছিলেন তিনি।
মঞ্চে সামনে এনে কিছুক্ষণের জন্য দাঁড় করানো হয় সালাউদ্দিন কাদেরকে। এ সময় তিনি বলেন, “আমি কোনো অপরাধ করিনি। ঘটনার সময় আমি দেশে ছিলাম না। আমাকে অন্যায়ভাবে ফাঁসি দেওয়া হচ্ছে।”
স্বাভাবিক কণ্ঠে কথাগুলো বলার পর নিস্তব্ধতা নেমে আসে ফাঁসির মঞ্চে। সেখানে উপস্থিত সব সরকারি কর্মকর্তারা চুপ করে যান। একটু পরে সালাউদ্দিন কাদেরকে ফাঁসির মঞ্চে উঠতে বলা হলে তিনি শান্তভাবেই ফাঁসির মঞ্চে ওঠেন। এরপর তার দুই পা বেধে ফেলা হয়। গলায় লাগানো হয় ফাঁসির দড়ি।
এ অবস্থায় সালাউদ্দিন কাদের নির্বিকারভাবে দোয়া কালাম পড়ছিলেন। তখন রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে। সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির তার হাতে থাকা শাদা রুমাল ফেলে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ফাঁসির দড়িতে টান দিল প্রধান জল্লাদ শাহজাহান।
‘আল্লাহু আকবার’ বলে স্তব্ধ হয়ে গেলেন সালাউদ্দিন কাদের। নিয়ম অনুযায়ী ১৭ মিনিট ঝুলিয়ে রাখা হয় তার মৃত্যুদণ্ড। এরপর তার লাশটি ফাঁসিকাষ্ঠ থেকে নামিয়ে মঞ্চের সামনে পাতা টেবিলে শোয়ানো হয়। কারা চিকিৎসক ডা. বিপ্লব কুমার ও আহসান হাবিব, ঢাকা জেলার সিভিল সার্জন আবদুল মালেক নিহত সালাউদ্দিন কাদেরের লাশের ঘাড়ের রগ কেটে ফেলে।
তবে কারাগারের একটি সূত্রের দাবি, রাত ১২ টা ৩০ মিনেটে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
পরে কারাগার থেকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর লাশ বের করে র্যাব-১০ এর একটি সশস্ত্র দল পাহাড়া দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার গহিরা গ্রামের উদ্দেশে রওনা করে। নিজগ্রামে ছোটভাইয়ের কবরের পাশে দাফন করা হবে বাংলাদেশে জনপ্রিয় রাজনীতিক সালাউদ্দিন কাদেরকে। অনলাইন বাংলা
জন্মভূমি ফরিদপুরের হাজারো মানুষের অশ্রুসজল দোয়া আর কান্নার মধ্য দিয়ে সমাহিত হয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ।
রবিবার প্রথম প্রহরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসি কার্যকরের পর সকাল ৭টা ১০ মিনিটে মুজাহিদের দাফন সম্পন্ন হয়। ফরিদপুরে তার প্রতিষ্ঠিত আইডিয়াল মাদ্রাসার গেটের বাইরের ডান পাশে তাকে কবর দেওয়া হয়েছে।
রবিবার ভোর ৬টা ৩৫ মিনিটে মুজাহিদের লাশ তার বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত মাওলানা আবদুল আলী ট্রাস্ট প্রাঙ্গণে নেওয়া হয়। সেখানেই কিছুক্ষণ পর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
জানাজায় পরিবারের সদস্য, জেলা জামায়াতের নেতা-কর্মী ও প্রশাসনের লোকজন উপস্থিত ছিল। এদের মধ্যে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আবদুর রশিদ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ কামরুজ্জামান ছিলেন।
এর আগে ব্যাপক নিরাপত্তার মধ্যে দিয়ে লাশ ঢাকা থেকে ফরিদপুরে মুজাহিদের গ্রামের বাড়ি পশ্চিম খাবাসপুরে এসে পৌঁছায়। সেখানে একটি জানাজা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে পরিবারের লোকজন ছাড়া বাইরের কেউ অংশ নিতে পারেনি।
মুজাহিদের বড় ভাই এবং ফরিদপুর জামায়াতের আমির আলী আফজাল মো. খালেছ জানান, জানাজায় পরিবারের সদস্য ছাড়াও স্থানীয় জামায়াতের নেতৃবৃন্দ অংশ নেন। তবে বাইরের কাউকে জানাজায় অংশগ্রহণ করতে দেয়নি স্থানীয় প্রশাসন।
জানাজার নামাজের ইমামতি করেন আফজাল মো. খালেছ।
এর আগে, কোতোয়ালি থানার এসআই মাসুদ জানান, পরিবারের সদস্যদের মতামত নিয়ে পশ্চিম খাবাসপুরে মুজাহিদের প্রতিষ্ঠিত আইডিয়াল মাদ্রাসার গেটের বাইরের ডান পাশে তার কবর খোঁড়া হয়।
রবিবার রাতে ফাঁসি কার্যকরের প্রায় দুই ঘণ্টা পর রাত ২টা ৪৯ মিনিটে লাশবাহী চারটি অ্যাম্বুলেন্স কারা ফটক দিয়ে বের হয়ে আসে। এর একটিতে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর এবং অপর একটিতে আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের লাশ রাখা হয়।
অ্যাম্বুলেন্সের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এর সামনে ও পেছনে র্যাব ও পুলিশের দুটি করে গাড়ি রাখা হয়।
মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মুহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসি রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে একই মঞ্চে পাশাপাশি ফাঁসিকাষ্ঠে কার্যকর করা হয়।
বাংলাদেশে এই প্রথম সাবেক দুজন মন্ত্রীকে ফাঁসি দেয়া হলো। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মুহাম্মাদ মুজাহিদ ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত পূর্ণমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন।
ফাঁসি কার্যকর করার সময় বেশ কয়েকজন কারা কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। শাহজাহান ও রাজু জল্লাদের নেতৃত্বে ছয়জন জল্লাদ প্রস্তুত ছিলেন।
ফাঁসির আগে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, আমি কোনো অন্যায় করিনি। ঈর্ষান্বিত হয়ে শেখ হাসিনা আমাকে ফাঁসিতে ঝোলাচ্ছে। তার বিচার আল্লাহ করবে।
জানা গেছে, রাত ১২টা ৪০ মিনিট থেকে ৪৫ মিনিটের দিকে শীর্ষ এই দুই নেতাকে কনডেম সেল থেকে বের করা হয়।
মুজাহিদ বলেন, আমি কোনো অন্যায় করিনি। এর বিচার আল্লাহ করবে।
এরপর ১২টা ৫০ থেকে ৫১ মিনিটে তাঁদের দুজনকে ফাঁসির মঞ্চে নেয়া হয়। ফাঁসির মঞ্চের লিভারের দায়িত্বে ছিলেন জল্লাদ শাহজাহান।
মুজাহিদ প্রথমে জমটুপি পরতে চাননি। তিনি বলেছেন, আমার কোনো অসুবিধা হবে না। জমটুপি পরাতে হবে না। তবে কারা কর্তৃপক্ষ তাকে রীতি অনুযায়ী তাঁকে জমটুপি পরতেই হবে বলে অনুরোধ করেন। পরে তিনি জমটুপি পরেন।
ফাঁসির কাষ্ঠে ওঠার আগে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ দুইজনই কলেমাসহ বিভিন্ন দোয়া-দরুদ পড়তে থাকেন। মঞ্চে ওঠার আগে তারা দুইজনে অজু করেন। দুই রাকাত নফল নামাজ পড়েন। রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
ডিবির উপপরিদর্শক নাজমুল আলম জানান, তাদের দুইজনকে একই মঞ্চে একই লিভারে ফাঁসি দেয়া হয়। এসময় তারা দুইজনই স্বাভাবিক ছিলেন। ১৫ মিনিটের মতো তাঁদের ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এরপর নামিয়ে এনে পায় ও ঘাড়ের রগ কেটে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়।
কারাগারে মাবরুরকে উদ্দেশ্যে করে মুজাহিদ বলেন, ‘এ জালিম সরকারের কাছে আমার প্রাণভিক্ষা চাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এই সরকার গত ৫ বছর আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগে মিথ্যা মামলা দিয়ে মিথ্যাচার করেছে। আজ এই শেষ মুহূর্তে এসেও তারা মিথ্যাচার অব্যাহত রেখেছে। মূলত আমাকে আমার দলের কাছে, আমার পরিবারের কাছে, দেশের মানুষের কাছে হেয় করার জন্য কাপুরুষ বানানোর জন্য তারা এ মিথ্য অপপ্রচারের নাটক করেছে।’
ফাঁসির মঞ্চের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে তারা বললেন...
‘আমি কোনো অন্যায় করিনি। ইসলামী আন্দোলন করার কারণে আমাকে হত্যা করা হচ্ছে’ -মুজাহিদ
আমি কোনো অন্যায় করিনি। এরও বিচার আছে। এই বিচার আল্লাহ করবেন -চৌধুরী
স্টাফ রিপোর্টার : দুই পরিবারের সদস্যরা কারাগার থেকে শেষ সাক্ষাৎ করে বের হওয়ার পরই সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সেলে হাজির হয় জল্লাদ বাহিনী। রাত তখন ১২টা ৪০ মিনিট। এ সময় পাশেই অবস্থান নেয় কারারক্ষীদের সম্বন্বয়ে গঠিত কারা কমান্ডো দল। পাশের সেলেই ছিলেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল সাবেক সফল মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। দুজনই সেলের ভেতরে তখন জায়নামাযে বসে নামায আদায় করে দোয়া দরূদ পড়ছিলেন। প্রধান জল্লাদ শাহজাহান ও তার দল সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সেলে ঢুকে বলেন, ‘স্যার আপনার সময় শেষ, আমাদের সাথে এখনই যেতে হবে’। দুই মিনিটের মধ্যে তাকে জমটুপি পরিয়ে ও হাতবেধে সেল থেকে নিয়ে ফাঁসির মঞ্চের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। জমটুপি ও হাত বাধা নিয়ে সালাহউদ্দিন কাদের জল্লাদদের বলতে থাকেন, এসবের আর দরকার নেই। আমিতো স্বেচ্ছায় যাচ্ছি। এরপরই জল্লাদরা পাশের সেল থেকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে একইভাবে জমটুপি পরিয়ে ও তার হাত বেধে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পেছনে পেছনে হাটতে শুরু করে। ১২টা ৫৩ মিনিটে দুজনকেই একই মঞ্চে তোলা হয়। গলায় ঝোলানো হয় দড়ি। কারাবিধি মোতাবেক এর আগেই মঞ্চের পাশে অবস্থান নেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। এরপর সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির তার হাত থেকে লাল রুমাল ফেলে দেয়ার সাথে সাথে প্রধান জল্লাদ শাহজাহান লিভার টান দেয়। মুহুর্তে দুজনের পাটাতন সরে গিয়ে কুপের মধ্যে ঢুকে পড়ে। এর আগে ফাঁসির সেলেই তাদের দুজনকে কারা মসজিদের ঈমাম হাফেজ মো. মনির হোসেন তওবা পড়ান। এ সময়ের মধ্যে দুজনের একাধিকবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন কারাগারের চিকিৎসকরা।
প্রত্যক্ষদর্শী ও কারাগার সূত্রে জানা যায়, গত শনিবার সকাল থেকেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে আইন শৃংখলাবাহিনীর সদস্যরা সতর্ক অবস্থান নিতে শুরু করে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে প্রশাসনের তৎপরতাও বাড়তে থাকে। সকাল ১০টার দিকে কারাগারে প্রবেশ করেন দুজন মেজিস্ট্রেট। তারা বেলা ৩টা ২৬ মিনিটে কারাগার থেকে বের হলেও কারো সাথে কথা না বলে সোজা গাড়িতে উঠে চলে যান। বেলা সাড়ে ৩টার দিকে আইজি প্রিজন্স ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিনের দফতর থেকে একটি লাল খাম নিয়ে একজন কারারক্ষী (ম্যাসেঞ্জার) ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রবেশ করেন। মেডিকেলের একটি ব্যাগের মতো একটি ব্যাগে তিনি খামটি নিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র সেল সুপার মো. জাহাঙ্গীর কবিরের কাছে পৌঁছে দেন। এই খামেই কখন কোন সময় ফাঁসি কার্যকর করা হবে তার উল্লেখ থাকে। এরপর সেটি কারাগারের রেজিস্ট্রারে তা উল্লেখ করার নিয়ম রয়েছে বলে কারাগার সূত্র জানায়। বিকেলের পর পুলিশ র্যাব ছাড়াও আইন শৃংখলাবাহিনীর তৎপরতা আরো বাড়তে থাকে। তবে মাঝে দুই আসামীর পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপ্রতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার আবেদনের একটি স্ত্রুল টিভি মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে এ নিয়ে শুরু হয় নানা গুঞ্জন। এই অবস্থায় কারাগারের প্রধান গেটের পাশে অনুসন্ধানের সামনে অপেক্ষায় থাকা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর দুজন আইনজীবি আবেদন করেও সাক্ষাৎ পাচ্ছিলেন না। প্রাণভিক্ষার আবেদনের বিষযটি নিয়ে সাংবাদিকরা তাদের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেছেন এমনটি শুনছি। কিন্তু এটা কোনোভাবে সম্ভব নয় দাবি করে বলেন, আমার এই বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ হচ্ছে। সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত অপেক্ষার পরও তিনি সাক্ষাৎ না পেয়ে ফিরে যান। তখনও ফাঁসি কার্যকর হবে কি না এ নিয়ে সবার মধ্যে সন্দেহ দেখা দেয়। সন্ধ্যার পর কারাগারের দক্ষিণ পশ্চিম পাশে বড় বড় তিনটি লাইট জ্বলে উঠলে তখন অনেকেই ধারণা করতে শুরু করে। ফাঁসি কি তাহলে আজই হচ্ছে। কিন্তু এখানে ফাঁসি হওয়ার কোনো আলামততো দেখা যাচ্ছে না। এর মধ্যে একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, আমার কাছে খবর আছে ফাঁসি হওয়ার সম্ভবনা ৯৯%। তার এই কথাও কেউ তেমন আমলে নিতে চাননি। সবার দৃষ্টি রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে যে প্রাণভিক্ষার আবেদন গেছে তার ফয়সালাহ না হওয়া পর্যন্ত কিভাবে আজ ফাঁসি কার্যকর হবে? এভাবে সময় গড়ানোর মধ্যে হঠাৎ সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর স্ত্রী, দুই সন্তান ও মেয়ে ও মেয়ের জামাই এসে কারাগারে হাজির হন। তাদের মধ্যে দুই ভাই এসে সাংবাদিকদের বলেন, আমাদেরকে কেউ ডাকেনি। আমরা নিজেরাই এসেছি। তখন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হুম্মান কাদের চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, বাবা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে আবেদন করেছেন এমনটা শুনেই এসেছি। কিন্তু আমরা যেহেতু বাবার সাথে কথা বলতে পারিনি তাই প্রাণভিক্ষার বিষয়টি মোটেও ঠিক নয় বলে জানান তিনি। যাওয়ার সময় বলে যান আমরা আবার আসছি। রাত তখন ৮টা। হঠাৎ আইন শৃংখলাবাহিনীর সদস্যদের তৎপরতা বেড়ে যায়। গোয়েন্দা সংস্থা ডিবির টীম চলে আসে। কারাগারের চারপাশের রাস্তাঘাটে যানচলাচল কমে আসে। ৮টা ২ মিনিটে কারাগারে আসেন এডিশনাল আইজি প্রিজন্স কর্ণেল ফজলুল কবীর। তিনি সোজা চলে যান কারাগারের ভেতরে। জরুরী প্রয়োজন ছাড়া তিনি কারাগারে আসেন না। এরপরই সবার মনে দানা বাধতে শুরু করে। তাহলে কি আজ ফাঁসি হতে যাচ্ছে। এরপরই একে একে আসতে থাকেন ঢাকার জেলা প্রশাসক, আইজি প্রিজন্স ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন, সিভিল সার্জন, গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি। তাহলে কি স্বজনদের সাথে শেষ সাক্ষাৎ না করেই ফাঁসি কার্যকর হয়ে যাবে? এমন প্রশ্ন যখন ঘুরপাক খাচ্ছে ওই সময়ই খবর আসে সালাহউদ্দিন কাদের ও মুজাহিদের পরিবারের সদস্যদের দেখা করতে খবর দেয়া হয়েছে কারাগারের পক্ষ থেকে। এরপরই সবাই ধরে নেন আজই হতে যাচ্ছে ফাঁসির রায় কার্যকর। এরপরই দুই পরিবারের সদস্যরা কারাগারে চলে আসেন। প্রথমে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সাথে পরিবারের ১৭ জন সদস্য সাক্ষাৎ করেন। তারা বের হওয়ার পর সাক্ষাৎ করতে যান মুজাহিদের পরিবারের ২৫ সদস্য। তারা রাত ১২টা ২৫ মিনিটে কারাগার থেকে বের হয়ে আসেন। দুজনের পরিবারের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের জানানো হয়, তারা কেউই প্রাণভিক্ষার জন্য রাষ্ট্রপ্রতির কাছে আবেদন করেননি। তারা বের হওয়ার পরই শুরু হয় জল্পনা কল্পনা। এ সময় কেউ কেউ বলতে থাকেন, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকর হয়ে গেছে। কোনো কোনো টেলিভিশন চ্যানেল ১২টা ১ মিনিটে ফাঁসি কার্যকর হয়ে গেছে বলেও স্ত্রুল দিতে শুরু করে। কেউ দেয় সাড়ে ১২টায়। আবার কোনো কোনো মিডিয়া ১২টা ৪৫ মিনিটে ফাঁসি কার্যকর হয়ে গেছে বলে প্রচার শুরু করে। তবে কারাগার সূত্র জানায়, আইজি প্রিজন্স অফিস থেকে যে লাল খামটি কারাগারের সুপারের কাছে গিয়েছে সেটিতে ফাঁসি কার্যকরের সময় উল্লেখ করা হয়েছে রাত ১২টা ১ মিনিট।
ফাঁসির দায়িত্বে থাকা একটি সূত্র জানিয়েছে, ফাঁসির রায় কার্যকর করার আগেই দুপুরে ও রাত ৮টার দিকে কারা হাসপাতালের ডাক্তার বিপ্লব কান্তি বিশ্বাস সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। সন্ধ্যার আগে তাদের কারাগার থেকে পরীক্ষা করে খাবার দেয়া হলেও তারা খাবার খাননি। কারণ তাদের ওই সময় খাবার খাওয়ার মনমানসিকতা ছিল না। এরপর কারা মসজিদের ঈমাম মনির হোসেন তাদের দুজনকে তওবা পড়াতে যান। কিন্তু দুজন নিজেরাই তওবা পড়বেন বলে জানান। পরে তাদের কারাবিধির কথা জানানো হলে তখন দুজন তওবা পড়েন। এরপরই কারাগারের ৮ নম্বর ফাঁসির সেলে (রজনীগন্ধা সেল) দক্ষিণ পাশের পাশাপাশি সেলে থাকা সালাহউদ্দিন ও মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকরের আগে ফাঁসির মঞ্চের সামনে অবস্থান নেন কারাবিধি মোতাবেক প্রশাসনের কর্মকর্তারা। তবে আইজি প্রিজন্স ফাঁসি হওয়ার আগেই কারাগার থেকে বেরিয়ে যান।
সূত্র জানায়, ফাঁসি কার্যকর করার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত থাকা প্রধান জল্লাদ শাহজাহানের নেতৃত্বে ৭ সদস্যের একটি দল ১২টা ৪০ মিনিটে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সেলে প্রবেশ করেন। তারা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সেলে ঢুকে বলতে থাকেন, স্যার আপনার সময় শেষ হয়ে গেছে। আপনাকে এখনই ফাঁসির মঞ্চে যেতে হবে। এরজন্য নিয়ম অনুযায়ী জমটুপি পরাতে হবে। দুই হাত পেছনে বাধতে হবে। তখন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী জল্লাদদের কথামতো জমটুপি পরতে অস্বীকৃতি জানান। একইভাবে হাত বাধতে চাননি। তবে তিনি জল্লাদদের বলেন, আমিতো এমনিতেই যাচ্ছি। এসবের দরকার নেই। ওই সময় তিনি বলতে থাকেন, আমি কোনো অন্যায় করিনি। এরও বিচার আছে। এই বিচার আল্লাহ করবেন। মাত্র ২ মিনিটের মধ্যে জল্লাদরা সাদাকালো কয়েদীর পোশাক পরা সালাহউদ্দিন কাদেরকে জমটুপি পরিয়ে ও হাত বেধে মঞ্চের দিকে নিয়ে এগুতে থাকে। এরপরই তিনি দোয়া দরূদ পড়তে থাকেন। একইভাবে মুজাহিদের সেলে প্রবেশ করে জল্লাদরা। জল্লাদ শাহজাহান ও রাজুসহ অন্যরা তাকেও জমটুপি ও পেছনে হাত বেধে নিয়ে যেতে শুরু করে। এ সময় মুজাহিদ তাদের শুধু বলেছেন, ‘আমি কোনো অন্যায় করিনি। ইসলামী আন্দোলন করার কারণে আমাকে হত্যা করা হচ্ছে’। সেল থেকে মাত্র ১০-১২ সেকেন্ডের ব্যবধানে দুজনকেই নিয়ে যাওয়া হয় ফাঁসির মঞ্চের দিকে। ওই সময় দুজনই স্বাভাবিকভাবে কলেমা পড়তে পড়তে এগিয়ে যেতে থাকেন।
কারাগার সূত্র জানায়, ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেছেন, আপনারা আমাদের জন্য দোয়া করবেন। আমাদের (দম) মৃত্যুটা যাতে তাড়াতাড়ি হয়ে যায়। ওই সূত্রটি আরো জানায়, যখন ফাঁসির মঞ্চে তুলে জল্লাদ লিভার টান দেয় তখন শুধু একটি শব্দ ভেসে আসে ‘আল্লাহ’।
কারাগারের অপর একটি সূত্র জানায়, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদের কাছে যখন কারা ডাক্তার যান তখন তিনি তাকে বলেছেন, পৃথিবীতে এক মিনিট বেঁচে থাকতে হলে আগে স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে হবে। ডাক্তার সাহেব আপনি স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। তবে ডাক্তারকে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেছেন, চেকআপ করবেন করেন। তখন ডাক্তার তাকে বলেছেন, স্যার আপনি হচ্ছেন মেহমান। তখন সালাহউদ্দিন বলেন, করেন, স্বাস্থ্যই তো চেকআপ করবেন।
এসব ব্যাপারে গতকাল রোববার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবীর ও জেলার নেছার আলমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তাদের মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়।
গতকাল বিকেলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে খোঁজ নিতে গেলে কেউ এ ব্যাপারে কথা বলতে রাজী হননি। জানা গেছে, এসব ব্যাপারে মিডিয়ার কাছে কেউ যাতে কোনো কথা না বলে, সে ব্যাপারে কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে আগেই সবাইকে সর্তক করে দেয়া হয়েছে।
প্রাণভিক্ষার আবেদন দেখতে চাই -মুজাহিদের ছেলে
আলী আহসান মোহম্মদ মুজাহিদ প্রাণভিক্ষা চেয়েছেন এবং সরকারের কাছে ওই আবেদন সংরক্ষিত আছে মর্মে গতকাল রোববার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল যে বক্তব্য দিয়েছেন তা আবারো নাকচ করে দিয়েছেন মুজাহিদের ছেলে আলী আহমাদ মাবরুর। গতকাল রোববার রাত সাড়ে ৮টায় এক প্রতিক্রিয়ায় মাবরুর বলেন, ‘আমরা গতকালই বলেছি যে, আমার বাবা আলী আহসান মোহম্মদ মুজাহিদ রাষ্ট্রপতির কাছে প্রানভিক্ষার আবেদন করেননি। আমি আবারও বলছি, সরকারের কাছে যদি প্রাণভিক্ষার আবেদন সংরক্ষিত থাকে, তাহলে। আমরা এটা দেখতে চাই। আমরা আমার বাবার হাতের লেখা ও স্বাক্ষর চিনি।’
‘৬ ফুট ২ ইঞ্চি তোমার বাবা, কারও কাছে মাথা নত করে না’ : ‘৬ ফুট ২ ইঞ্চি তোমার বাবা, কারও কাছে মাথা নত করে না’- ফাঁসি কার্যকরের আগে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শেষ সাক্ষাতের সময় প্রাণভিক্ষার বিষয়ে এভাবেই ছোট ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরীর প্রশ্নের জবাব দেন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত সালাহউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী।
রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার বিষয়ে হুম্মাম বলেন, বলা হচ্ছে- বাবা (সাকা চৌধুরী) প্রাণভিক্ষা চেয়েছেন। তাকে মানুষ বাংলার বাঘ হিসেবে চিনে। তিনি কখনো প্রাণভিক্ষা চাইবেন না। আমি যখন বাবার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম বাবা বলেছেন ‘৬ ফুট ২ ইঞ্চি তোমার বাবা, কারও কাছে মাথা নত করে না’।
0 comments: