শহীদ রেজাউল হায়াত রোমান (৩১.০৩.২০১৩)



শাহাদাতের তারিখ : ৩১ মার্চ ২০১৩ রাত ১১.২০ মিনিটে বার অাউলিয়া বাজার সংলগ্ন ঢাকা চট্রগ্রাম মহাসড়ক।তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী ভাইয়ের গ্রেফতারের পর তাৎক্ষনিক অবরোধ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কাভার্ড ভ্যানের চাকার নিচে পিষ্ট হয়ে শাহাদাৎ বরণ করেন।

২০১২ সালে এস এস সি পরীক্ষার পর ৭ এপ্রিল সে অামার কাছ থেকে সাথী শপথ গ্রহণ করেছিল। ৪ ভাই বোনের মধ্যে রোমান ছিল দ্বিতীয়। শাহাদাতের সময় সে একাদশ শ্রেনীতে পড়ালেখা করত। শিবিরের উপশাখা সভাপতি হিসেবে সে খুব পেরেশানি নিয়ে সংগঠনের দায়িত্ব পালন করত।



সংগঠনে অাসার পর থেকেই রোমান সবসময় শাহাদাতের প্রেরনায় উজ্জীবিত ছিল। শাহাদাতের দু'মাস অাগে রোমান তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নাকাটি করে অাল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করছিলেন" হে অাল্লাহ অামাকে শহীদ হিসেবে কবুল করো"।রোমানের কান্নার অাওয়াজে পিতার ঘুম ভেঙ্গে গেলে তিনিও উঠে তাহাজ্জুদ নামাজ অাদায় করেন। ফজরের নামাজের পর পিতা রোমানের মায়ের কাছে বলেন তোমার ছেলে বেশীদিন বেঁচে থাকবেনা। শহীদের বাড়ীর পাশে অবস্থিত মসজিদের মোয়াজ্জিনকে একদিন রোমান বলছিলো" হুজুর অামার জন্য দোয়া করেন অামি যেন অাল্লামা সাঈদীকে সরকার ফাঁসি দেয়ার অাগেই শাহাদাৎ বরণ করি"। যে রাতে রোমান শহীদ হয় সে রাতে সে এশার নামাজ পড়ে সবার কাছে মাপ চেয়ে নেন এবং তার পিতাকে উদ্দেশ্য করে বলেন,অাব্বা অাপনি কতটুকু ইসলাম বুঝেছেন জানিনা তবে অামি যতটুকু বুঝেছি জিহাদের ডাক অাসলে ঘরে বসে থাকার সুযোগ নেই। জিহাদের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যেতে হবে। রোমান তার বড় ভাই মুজাহিদ কে একদিন বললো," ভাইয়া কারো মনে কষ্ট দেয়া যাবেনা, কষ্ট পায় এমন কথাও বলা যাবেনা"। ছোট ভাই লিমন কে একদিন সে পরামর্শ দিয়ে বলে "ব্যক্তিগত রিপোট্ লিখতে কখনো ভুল করবেনা কারণ মৃত্যুর পর অার রিপোট্ লিখতে পারবেনা।

শহীদ রোমান তার ডায়েরীতে শাহাদাতের পূর্বে লিখে গিছেন " অামার মনের সকল অাশা পূরণ হবেনা, এমন করে চলে যাবো কেউ বুঝবেনা"।

গতকাল দুপুরে শহীদের কবর জিয়ারত করতে গিয়ে তা বাবা -মা, ভাইদের সাথে কথা হলে শহীদ রোমান সম্পর্কে কথাগুলো জানার সুযোগ হয়। তখনি অামার মনে পড়ে গেল তাকে সাথী শপথ দেয়ার পূর্ববর্তী সময়ের কথা। ছোট বিদায় অামি যখন তাকে শপথ দিতে কিছুটা সময় নিচ্ছিলাম তখন সে বললো ভাইয়া অামি সকল দিক থেকে প্রস্তুতি নিয়ে এসেছি অাপনি অামাকে শপথ দিয়ে দেন। সে দিন শপথের সময় রোমানের বাবা অাইউব অালী ও সেখানে ছিলেন। তিনিও অামাকে অভয় দিয়ে বললেন তাকে শপথ দিয়ে দেন, অামি তাকে যতটুকু দেখেছি সে পারবে। সত্যিই শহীদ রোমান ছিল এক অনুপ্রেরণার বাতিঘর। বয়স কম হলেও তার অামল ও কর্মতৎপরতা সকলকে অনেক বেশী অাকৃষ্ট করেছিল। অল্প দিনেই তার এলাকার সাধারণ ছাত্রদেরকে সে সংগঠনের বলয়ে নিয়ে এসেছিল। তার এলাকার মুরুব্বীরা এখনো তার কথা স্মরণ করে বলে যে রোমান থাকলে এতদিন অামাদের এলাকার সকল ছাত্রই সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যেত। রোমানের শাহাদাতের পর তার ছোট ভাই নবম শ্রেনীর ছাত্র লিমন এবছর এপ্রিল মাসে সাথী শপথ গ্রহণ করে। সত্যিই শহীদ রোমান এবং তার পরিবার অামাদের জন্য অনেক অনুপ্রেরনার। মহান অাল্লাহ অামাদের প্রিয় ভাই রোমানের শাহাদাৎ কে কবুল করুন। তার শাহাদাতের বিনিময়ে তিনি অামাদের নেতৃবৃন্দের মুক্তি নিশ্চিত করুন। -(আতিকুর রহমান)



পিতার কথা: সে সবসময় শাহাদাতের তামান্না পোষণ করত। শাহাদাতের এক মাস পূর্বে এক রাতে তাহাজ্জুদ পড়ে কান্নাকাটির সময় আমি এবং তার মায়ের ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে তখন আল্লাহর কাছে শাহাদাতের জন্য দোয়া করছিল খুব আকুতিভরে। আমাকে সে প্রায়ই বলত, আমি যা বুঝি- এই মুহুর্তে ঈমানের দাবী হচ্ছে জিহাদে অংশগ্রহণ করা, বসে থাকার কোন সুযোগ নেই।


মসজিদের ইমাম: একদিন সে আমাকে বলেছিল, আল্লাহ যেন মাওলানা সাঈদীর ফাঁসির পূর্বেই আমাকে শহীদ হিসেবে কবুল করেন।

এলাকাবাসীর মন্তব্য: সে সবার কাছে প্রিয় ও পরিচিত মুখ ছিল। সে খুবই পরহেযগার ছেলে ছিল। নিয়মিত নামাজ আদায় করত। গত রমজানে সে ই’তেকাফ করেছিল। তার ব্যবহার ছিল খুবই অমায়িক। সে কখনো কারো মনে কষ্ট দিত না। তাকে হারিয়ে এলাকাবাসী হারালো একজন নিয়মিত মুসল্লি।





যেভাবে শহীদ হলেন

৩১ মার্চ, ২০১৩। এই কাফেলার সিপাহসালার মুহতারাম কেন্দ্রীয় সভাপতি মো: দেলোয়ার হোসেন ভাইকে সম্পূর্ণ মিথ্যা মামলায় গ্রেফতারের প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে ছাত্রশিবিরের জিন্দাদিল মর্দে মুজাহিদেরা। সংগঠন থেকে ঘোষণা করা হয় বিক্ষোভ মিছিল ও অবরোধের। শুরু হলো সারা বাংলাদেশে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ। তারই অংশ হিসেবে আইআইইউসি শাখার পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয় বিক্ষোভ মিছিল ও অবরোধ। মিছিলটি সংঘটিত হয় কুমিরা বাজারে। তাতে অংশ নেন শহীদ রেজাউল হায়াত রোমান। মিছিলে তার শ্লোগান ছিল অন্য দিনের চেয়ে ভিন্ন। নারায়ে তাকবীরের শ্লোগানে প্রকম্পিত করেছিল আকাশ-বাতাস।

একপ্রকার কোনো বাধা ছাড়াই মিছিলটি সম্পন্ন হয়। রাতে অবরোধের সিদ্ধান্ত হয় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বার আউলিয়া এলাকায়। সিদ্ধান্তের আলোকে আমাদের ভাইয়েরা অংশ নেয় অবরোধ কর্মসূচিতে। শহীদ রেজাউল হায়াত রোমান রাতের বেলায় না খেয়ে অংশগ্রহণ করেন সেই অবরোধে। শহীদ হওয়ার দুই ঘণ্টা আগে সংগঠনের সাথী তার ক্লাসমেট সাইফুল ইসলামের সাথে বলাবলি করতে থাকেন এই শাখাতে যদি কেউ প্রথম শহীদ হয় তাহলে আমি-ই হবো প্রথম শহীদ। কথার কী অপূর্ব মিল! অবরোধ পালন করতে গিয়ে ঘাতক ট্্রাকের নীচে পিষ্ট হয়ে রাত ১১.২০ মিনিটে শাহাদাতের অমীয় শুধা পান করেন সংগঠনের সাথী শহীদ রেজাউল হায়াত রোমান। শহীদ হওয়ার সময় তার মোবাইলে রিংটোন বাজছিল ‘‘মানবতা দিকে দিকে কাঁদছে/শোকের পাথর বুকে বাঁধছে…।



স্মৃতিতে অম্লান শহীদ রোমান

শহীদি কাফেলা বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরে শামিল হয়ে কর্মী হওয়ার পর থেকে জীবন পরিচালনার দিগন্তে আসে ব্যাপক পরিবর্তন। ইসলামকে জানা, পালন করা ও ইসলাম প্রতিষ্ঠায় যথাযথ ভূমিকা রাখাই ছিল তার প্রধান কাজ। এই চেতনাতেই নেন সাথী শপথ। শপথ গ্রহণ করার পর থেকেই সদা-কর্মচঞ্চল দেখা যায় তাকে। সরকারের জুলুম-নির্যাতনের প্রতিবাদে ডাক আসে ঢাকা চলো কর্মসূচির। কর্মসূচিতে অংশ নেন তিনি। এবং বলতে থাকেন আমি ঢাকা যাবো শহীদ হতে। শাহাদাতের দুইমাস আগে রোমান তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নাকাটি করে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করছিলেন, হে আল্লাহ! আমাকে শহীদ হিসেবে কবুল করো। কান্নার আওয়াজে পিতার ঘুম ভাঙ্গে। পিতাও তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করেন। ফজরের পর শহীদ রোমান ভাইয়ের পিতা তার মায়ের কাছে বলেন, ‘তোমার ছেলে বেশিদিন বেঁচে থাকবে না।’

শহীদের বাড়ির পাশের মসজিদের ইমামের সাথে রোমান একদিন বলছিলেন ‘হুজুর! আমার জন্য দোয়া করেন, আমি যেন আল্লামা সাঈদীর ফাঁসির আগে শাহাদাত বরণ করি।’ শহীদের মায়ের সাথে কথা বলতে গেলে তিনি আমাকে বলেন, রোমান একদিন তাঁর মাকে বলেন, ‘মা! কিছুদিন আগে এক ভাই শাহাদাত বরণ করেছেন, যার পাঁচ বোন রয়েছে, তার কোনো ভাই নেই। আমি শহীদ হলে কোনো সমস্যা নেই, তোমার আরো দুই ছেলে আছে।’ যে রাতে শহীদ হন সে রাতেই এশার নামাজ পড়ে সবার কাছ থেকে মাফ চেয়ে নেন। এবং পিতাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আব্বা! আপনি কতটুকু ইসলাম বুঝেছেন জানি না, তবে আমি যতটুকু বুঝেছি, তা হলো, ঘরে বসে থাকার সুযোগ নেই। জিহাদের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যেতে হবে।’ বড়ভাইকে উদ্দেশ্য করে একদিন বলেন, ‘কারো মনে কষ্ট দেয়া যাবে না। কষ্ট পায় এমন কথাও বলা যাবে না।’ ছোট ভাইকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘ব্যক্তিগত রিপোর্ট লিখতে কখনো ভুল করবে না কারণ মৃত্যুর পর আর রিপোর্ট লিখতে পারবে না।’

শহীদের পিতা-মাতার আকুতি আমার ছেলে দীনের জন্য শহীদ হয়েছে, এতে আমরা শঙ্কিত নই। তোমরা তাঁর কাজকে বাস্তবায়ন করো।

লেখক : মু. রেজাউল করিম (সভাপতি, আইআইইউসি, চট্টগ্রাম)


0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম