অধ্যায় ০৪ : যে আলো ছড়িয়ে গেলো সবখানে

পোর্ট সাঈদের জনসমাবেশে আলজামালিয়ার একটি প্রতিনিধি দল অংশগ্রহণ করে। সমাবেশের পর তারা থেকে যান এবং আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা করেন। তারা নিজ এলাকায় আন্দোলনের প্রচার প্রসারের দৃঢ় সংকল্প নিয়ে ফিরে যান। উস্তাদ মোস্তফা আততহুরের নেতৃত্বে সেখানে ইখওয়ানের অফিস খোলা হয়।

এক সময় আল মনজিলা নামক স্থানে সমাবেশের আয়োজন করে হাসানুল বান্নাকে বক্তৃতা করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। লোকালয়ের বাইরেই তাকে স্বাগত জানানো হয়। যখন তারা হাসানুল বান্নার সাথে সাক্ষাৎ করেন তখন তাদের ঠোঁটে একটা অর্থপূর্ণ মুচকি হাসি লেগেছিল। অবশেষে হাসানুল বান্না উস্তাদ মোস্তফা আত তহুরকে একা পেয়ে জিজ্ঞেস করেন, এ লোকগুলো মুচকি মুচকি হাসছিলো কেন? শাইখ মোস্তফা বলেন, তাদের হাসির মূল কারণ এটাই যে, তারা আপনাকে যে রকম কল্পনা করেছিলো, আপনি তার সম্পূর্ণ বিপরীত।

তাদের ধারণা ছিল হাসানুল বান্না নামের ব্যক্তি একজন বয়স্ক বিশাল দেহের অধিকারী নূরানী চেহারার আলেম হবেন। কিন্তু তারা দেখতে পায় যে, এই ব্যক্তি তো একজন যুবক মাত্র- যার বয়স বড় জোর পঁচিশ বছর হবে। এখন আপনার দায়িত্ব হলো এসব লোকের বিশ্বাস ও আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করতে আপনাকে পুরোপুরি চেষ্টা চালাতে হবে।

জবাবে হাসানুল বান্না বলেন, হে আমার প্রিয় ভাই! সামর্থ্য ও সাফল্য আল্লাহতায়ালার হাতে। তিনি যদি কল্যাণের সিদ্ধান্ত দেন তাহলে সবকিছুই সফলভাবে সাধিত হয়। শরীরের দু’টি অংশের নাম হলো মানুষ। এর একটি হলো জিহবা আর অপরটি হলো অন্তর। আমরা জিহবার করণীয় পালন করতে পারি। আর মানুষের অন্তর রহমানুর রাহিমের আঙ্গুলের মাঝখানে। তিনি চাইলে তাদের অন্তরকে যেকোন দিকে ফিরিয়ে দিতে পারেন। যতদূর চোখ যায়, সমাবেশে শুধু মানুষ আর মানুষ। সমাবেশ শেষে মানুষ হাসানুল বান্নার কাছে এসে তাদের আবেগ প্রকাশ করতে থাকে। কিন্তু বক্তৃতা শুরু হবার আগে তো তারা বিশাল দেহী শাইখকে দেখার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেছিলেন। এখন তারা একজন সত্যিকার শাইখকে দেখার সুযোগ পেয়েছেন। এ সমাবেশের পর ঐ এলাকার সব জনপদেই ইখওয়ানের শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়।

লোহিত সাগর এলাকার সকল জনপদ সুয়েজ কেন্দ্রের অধীনস্থ ছিল। হাসানুল বান্না কয়েকবার ঐ এলাকা ভ্রমণ করেন। অবশেষে শাইখ আফিফি আশ শাফীর নেতৃত্বে এ এলাকায় সংগঠন অস্তিত্ব লাভ করে। একবার হাসানুল বান্না সুয়েজ এলাকায় গিয়ে আন্দোলনের এক সাথীর বাড়িতে ওঠেন। সেখানে টেবিলে রাখা একটি বই খোলা মাত্রই একটি হাদিসের উপর তার দৃষ্টি পড়ে। হাদিসটি হলো, রাসূল (সা.) মেহেদী খুব পছন্দ করতেন। রাসূলের (সা.) অনুসরণে হাসানুল বান্নার অন্তরেও মেহেদীর ডালের আকাঙ্ক্ষা জাগে। কিন্তু এখানে সেটা কিভাবে পাওয়া সম্ভব! তিনি তো নিজের শহর ও বাড়ি থেকে অনেক দূরে।


কিছুক্ষণ পর বক্তৃতা করার জন্য তিনি ইখওয়ান অফিসে চলে যান। বক্তৃতা করার সময় তার পিঠ জানালার দিকে ছিলো। জানালার কাছে ও এর আশপাশে ছেলেপেলে ভিড় জমায়। আকস্মিক একটি ছেলে মেহেদীর একটি মোটা ডাল শাইখ আফিফির হাতে ধরিয়ে দিয়ে হাসানুল বান্নার দিকে ইঙ্গিত দিয়ে বোঝাতে চায় যে, ঐ ডালটি যেন বক্তৃতা দানকারী শাইখকে দেয়া হয়। শাইখ এসে ঐ ডালটি হাসানুল বান্নার সামনে রেখে বলেন, শহরের বাচ্চাদের পক্ষ থেকে এটা আপনার জন্য উপহার। হাসানুল বান্না মুচকি হেসে ঐ ডালটি হাতে নিয়ে বলেন, এটা বাচ্চাদের উপহার নয় বরং রাসূলের (সা.) প্রতি ভালবাসা ও তাকে স্মরণ করার এক সুগন্ধী বাতাস। এই পবিত্র আকস্মিকতায় তিনি পুরো দিন আনন্দে ডুবে থাকেন।

মিসরের রাজধানী কায়রোর আল ফালাকী সড়কে অবস্থিত কমার্শিয়াল স্কুলে জমিয়তে তাহজিবে ইসলাম নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এই সংগঠনের প্রাণপুরুষ ছিলেন হাসানুল বান্না থেকে ২ বছরের ছোট তারই সহোদর আবদুর রহমান আল বান্না। তার সাথে যুক্ত ছিলেন আরো অনেক ছাত্র। ছুটির পর স্কুলের মসজিদ তাদের জমায়েত ও কর্ম তৎপরতার কেন্দ্রে পরিণত হয়। তাদেরকে বেশ কয়েকবার সহপাঠী ছাত্রদের কাছ থেকে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ ও স্কুলের কর্মচারীদের পক্ষ থেকে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়। তবুও এসব যুবক খুবই ভদ্রতা ও ধৈর্যের সাথে ইসলামী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের প্রচার চালিয়ে যেতে থাকেন। লেখাপড়া শেষ করে আবদুর রহমান আল বান্না ও তার বন্ধু মাহমুদ সা’দী রেলওয়ের প্রকৌশল শাখায় এক সাথে চাকরি লাভ করেন। তারা সেখানেও ইসলামের মহান শিক্ষা তুলে ধরার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। সেখানে তারা দরস ও আলোচনার অনুষ্ঠান চালু করেন। ধীরে ধীরে বহু জ্ঞানীগুণী লোক তাদের এই সংগঠনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন।

এরই মধ্যে জমিয়তে তাহজীবে ইসলামীর নেতৃবৃন্দ ইসমাঈলিয়ার ইখওয়ানুল মুসলেমুনের কর্মতৎপরতা, চেষ্টা সাধনার বিষয়ে খোঁজ খবর করার চেষ্টা করেন এবং এ শহরের এলাকায় এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইখওয়ানের শাখাসমূহের সন্ধান লাভ করেন। অতএব, তারা উপলব্ধি করেন যে, অনৈক্যের চেয়ে ঐক্যই উত্তম। সুতরাং তারা ইসমাঈলিয়ার ইখওয়ান কেন্দ্রের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে জমিয়তে তাহজীবে ইসলামীকে ইখওয়ানুল মুসলেমুনের সাথে একীভূত করে ফেলেন। এরপর ইখওয়ান কায়রোর সুক আসসালাহ সড়ক এলাকায় একটি নতুন অফিস ভাড়া নেয়। ইখওয়ান কর্মীরা নিজেরা এই অফিসের সংস্কার, মেরামত, সাজসজ্জা ও সৌন্দর্য বর্ধন করে রাজধানীর জন্য মানানসই একটি দফতরে রূপান্তরিত করেন। কায়রোতে ইখওয়ানের অর্থনৈতিক অবস্থা অফিসের ব্যয়ভার নির্বাহ করার মতো ছিলো না। যতদিন পর্যন্ত এই ব্যয়ভার বহন করার মতো যথেষ্ট সংখ্যক ব্যক্তিবর্গ ইখওয়ানে শামিল না হয়ে ততদিন পর্যন্ত ইসমাঈলিয়ার সংগঠন এ দায়িত্ব বহন করে যেতে থাকে। কেননা ইখওয়ানের সুস্পষ্ট নীতিমালা এই ছিল যে, তারা কারো কাছে আর্থিক সাহায্য চাইবেন না। তারা প্রতীক্ষা করতেন মানুষ যেন ইখওয়ানকে মনে প্রাণে গ্রহণ করে এবং পরবর্তিতে আপনা-আপনি তাদের মধ্যে আর্থিক ত্যাগের অনুভূতি জাগ্রত হয়।

ইখওয়ান মানুষের অন্তর জয়ের আকাঙ্ক্ষী ছিলো পকেট জয়ের নয়। এ ব্যাপারে তারা কতটুকু আত্মনির্ভরশীল ছিলেন তার একটি উদাহরণ এখানে তুলে ধরা হলো। সবেমাত্র কায়রোতে আন্দোলনের চারা রোপণ করা হয়েছে। ইখওয়ানের আর্থিক সহযোগিতার তীব্র প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে। এ সময় সরকারের পক্ষ থেকে বিপুল অংকের আর্থিক অনুদানের প্রস্তাব দেয়া হলো। বলা হলো, এর বিনিময়ে ইখওয়ান সরকারের গৃহীত নীতিমালা ও কর্মকান্ডের পক্ষে প্রচার প্রচারণা চালাবে। আবদুর রহমান আল বান্না যিনি একজন সাধারণ সরকারি কর্মচারী ছিলেন- তিনি এর জবাবে জানিয়ে দিলেন যে, যে সাহায্য বা অনুদানের লক্ষ্য ইসলামী দাওয়াতকে ব্যক্তিগত লাভ-লোকসান ও প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণে নিয়োজিত করা, আমাদের হাত কেটে ফেলা হলেও তা এমন কোন সম্পদের দিকে সম্প্রসারিত হবে না, যে সম্পদের ওপর আমাদের কোন অধিকার নেই। আমরা যদি বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর সন্তুষ্ট থাকতাম তাহলে নিজদের সেবার বিনিময় গ্রহণ করা ছাড়াই এর স্বার্থে নিজদের জীবন ও সম্পদ বিলিয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়াকে অবশ্য কর্তব্য মনে করতাম। আর এভাবেই আল্লাহ তায়ালা প্রথম দফায়ই ইসলামী দাওয়াতকে প্রলোভনের কালিমুক্ত রাখার ব্যবস্থা করেছেন। এই প্রলোভনের কালিমা কোন আন্দোলনের সাথে যুক্ত হলে তা অতি সহজেই ধ্বংস হয়ে যায়।

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম