ইসমাঈলিয়া থেকে পনের কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আবু সুবায়ের স্টেশনে নেমে হাসানুল বান্না এলাকার বাজারে ঢুকে ঘোরাফেরা করতে থাকেন। তিনি বাজারে এমনভাবে পায়চারী করেন যেন কোন ব্যক্তির চেহারা আন্দাজ করার চেষ্টা করছেন। অবশেষে তিনি এক দোকানদারকে গ্রাহকদের সাথে আলাপ আলোচনা করতে ও দোকানদারী করতে দেখতে পেয়ে ধারণা করেন যে, এই দোকানদার প্রশান্ত হৃদয় ও সঠিক পথের যাত্রী এবং বাচনভঙ্গিতেও দক্ষ ও যোগ্য। দোকানদারের কাছে আরো কয়েকজন লোকও বসা আছেন। হাসানুল বান্না তাদেরকে সালাম জানিয়ে তাদের কাছে বসে যান। একজন অপরিচিত ব্যক্তিকে তাদের কাছে বসতে দেখে মুহূর্তের জন্য তারা হতচকিত হলেও পুনরায় নিজেদের আলাপ আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এরই মাঝে দোকানদারের ব্যস্ততা কিছুটা কমে আসে।
হাসানুল বান্না নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন, এক ব্যবসাতো আপনি এ মুহূর্তে করে যাচ্ছেন। আরো একটা এমন ব্যবসা আছে যা করলে আমরা সবাই ভয়াবহ আজাব থেকে বাঁচতে পারি। আর এ ব্যবসা হলো, ঈমান আনার পর জীবন ও সম্পদ দিয়ে আল্লাহর পথে সংগ্রাম করা। হাসানুল বান্নাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই দোকানদার বলে বসেন, আপনি কি কোন কল্যাণ সংস্থার জন্য আর্থিক সহযোগিতা চাচ্ছেন?
না ভাই! আমার বক্তব্য এর চেয়েও অনেক উচ্চ স্তরের। আমি আপনার মাঝে কল্যাণের লক্ষণ দেখতে পেয়েছি, তাই আমি আপনাকে সে ব্যাপারে দাওয়াত দিচ্ছি যা আপনার জন্য অধিকতর কল্যাণ বয়ে আনবে। হাসানুল বান্নার এ ধরনের বক্তব্যে দোকানদার বিস্মিত হলেন। তিনি তার প্রতি অধিকতর আকৃষ্ট হয়ে বলেন, জী, বলুন! বলুন!।
‘হে আমার ভাই! ইসলামের নির্দেশাবলী কত পবিত্র ও ন্যায়নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু আমাদের সমাজে অন্যায় অনাচার ও জুলুম ব্যাপকভাবে শেকড় গেড়ে বসেছে। ভিন দেশীরা আমাদের উপায় উপকরণ দখল করে নিয়েছে আর আমরা তাদের দয়া ও অনুগ্রহের ভিখারী। এটা কেন হয়? আমরা ইসলামের নির্দেশাবলীকে পশ্চাতে ফেলে রেখেছি বলেই আজ আমাদের এহেন পরিণতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। এ মুহূর্তে প্রয়োজন এমন এক বিপ্লবের যার মাধ্যমে সব কিছু সংশোধিত হয়ে যাবে। তা না হলে আমরা সবাই অপরাধী হিসেবে গণ্য হবো। কেন না, সৎ কাজের নির্দেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ এবং উপদেশ দান ও সঠিক পথ প্রদর্শন আমাদের জন্য অবশ্য কর্তব্য।’
‘জী হ্যাঁ, আপনি সঠিক কথাই বলেছেন। আমরা তো সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু অন্যায় অনাচারের পৃষ্ঠপোষকরা সংখ্যায় অনেক বেশি।’ ‘খারাপ লোকের সংখ্যা ভালো লোকের চেয়ে বেশি নয়। তবে কথা হলো মন্দ লোকেরা নিজদের অপকর্মের সংরক্ষণ ও বিস্তারে ঐক্যবদ্ধ এবং তারা এক্ষেত্রে একে অপরের সহায়তাকারী। অপরদিকে ভাল লোকেরা নিজদের ভাল কাজে একা একাই নিমগ্ন। এ অবশ্য কর্তব্য পালন বিচ্ছিন্নভাবে সম্ভব নয়। বরং এমন জনমত সৃষ্টি করা জরুরি যা সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ দানের পৃষ্ঠপোষকতা করতে সক্ষম। সৎ লোকদের একটি সংগঠন প্রত্যেক মহল্লায় সক্রিয় থাকবে, তারা শুধুমাত্র এই দাওয়াতের প্রতি ঈমান পোষণকারী ও পালনকারীই হবে না বরং তারা সংগঠিত হয়ে এ আহবানকে ছড়িয়ে দিবে। কেন না, আল্লাহ পাকের নির্দেশ হলো, তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল অবশ্যই থাকবে যারা কল্যাণের আহবানের সাথে সাথে অকল্যাণকে প্রতিহত করবে এবং কল্যাণের নির্দেশও দান করবে। একথা স্পষ্ট যে, অকল্যাণের হোতারা এ কাজ কখনোই পছন্দ করবে না। এ জন্য অকল্যাণকারী শক্তির মোকাবেলা সুসংগঠিত কল্যাণ কাজের মাধ্যমেই সম্ভব।’
দোকানদার খাওয়ার দাওয়াত দিলে হাসানুল বান্না অপরাগতা প্রকাশ করে বিদায়ের অনুমতি প্রার্থনা করেন। দোকানদার মসজিদে বক্তৃতা করার জন্য তাকে জোরাজুরি করতে থাকেন। কিন্তু হাসানুল বান্না কফি খানায় বক্তৃতা করাই পছন্দ করেন। দোকানদার গভীর মনযোগের সাথে হাসানুল বান্নার প্রস্তাব শ্রবণ করেন এবং অবশেষে তার প্রস্তাব মঞ্জুর করা হয়। কফিখানায় লোকজন সমবেত হয়। তারা গভীর মনযোগ দিয়ে তার বক্তৃতা শ্রবণ করেন। জনতা যা কিছু দেখেছেন এবং শুনেছেন তাতে তাদের বিস্ময় আরো বেড়ে গেছে। সবার মনেই প্রশ্ন জেগেছে, ইসলামের আহবানকারী সুদর্শন চেহারার এই যুবক শিক্ষক মসজিদের ইমামও নন কিম্বা কোন তরিকার শাইখও না। হাসানুল বান্না ভবিষ্যতে সেখানে যাবেন তারা তার কাছ থেকে এ প্রতিশ্রুতিও আদায় করে নেন।
হাসানুল বান্না মাঝে মাঝেই আবু সুবায়ের আগমন করতে থাকেন। অবশেষে স্থানীয় লোকদের প্রস্তাব অনুযায়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আবদুল্লাহ বাদাওয়ীকে স্থানীয় ইখওয়ানের মুর্শেদ নিযুক্ত করা হয়। তিনি একজন জ্ঞানী মিশুক ও একজন খোদাভীরু মানুষ। সুতরাং তিনি একা একটি পরিত্যক্ত মসজিদ মেরামত করে সেখানে ইখওয়ানের প্রশিক্ষণ কাজের সূচনা করেন। সুতরাং আবু সুবায়েরের লোকজন ইখওয়ানের দাওয়াতের মাধ্যমে নতুন নতুন বিষয় অবহিত হতে থাকেন। এখানকার সাংগঠনিক খরচ পাতি বা ব্যয় নির্বাহের ভার ইসমাঈলিয়ার ইখওয়ানই বহন করতে থাকে। দাওয়াত ও আন্দোলনের ক্ষক্ষত্রে খোদায়ী বিধান হলো, দাওয়াত দানকারী ব্যক্তিবর্গ মানুষের কাছ থেকে কোন প্রকার প্রতিদান কিংবা বিনিময় প্রার্থনা করবে না। যদি কেউ বিনিময় প্রার্থনা করে তা হলে জনগণ কৃপণতা প্রকাশ করবে। দাওয়াতের প্রতি তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে এবং তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে। যখন জনগণের অন্তরে ইমান পরিপক্ব ও সঠিকভাবে গেঁথে যায় তখন তারা স্বেচ্ছায় শুধু সম্পদই ব্যয় করে না বরং নিজদের মূল্যবান জীবন বিলিয়ে দিতেও পিছপা হয় না।
* * * *
ইসমাঈলিয়ায় আহমদ আফেন্দি নামে এক যুবক ছিলেন। তার বয়স ছিল সতেরো/আঠারো বছর। এখানে তার কাজ শেষ হওয়ার পর তিনি নিজের শহর পোর্ট সাঈদ চলে যান। তিনি সাথে করে নিয়ে যান এ সত্য আহবানের আলোক বর্তিকা। একটি রোগবালাইহীন সতেজ বীজ যেখানেই বপন করা হোক সেখানেই অঙ্কুরোদগম হবে। ঠিক এই পুতঃপবিত্র দাওয়াতের উদাহরণও ঐ বীজের মতই। পোর্ট সাঈদে দাওয়াতের বিস্তার ঘটানোর জন্য আহমদ আফেন্দি অক্লান্ত পরিশ্রম করতে থাকেন। এর ফলে সৎ চরিত্র বন্ধু বান্ধব ও স্থানীয় পুণ্যাত্মা যুব গোষ্ঠী খুব দ্রুত তার চারদিকে সমবেত হতে থাকেন। পোর্ট সাঈদের আলমিনা সড়কে খুবই সাধারণ একটা জায়গা ভাড়া করে তারা সেখানে ইখওয়ানের একটা দফতর স্থাপন করেন। সংগঠনের লোকদের কাছ থেকে সংগৃহীত অর্থ অফিস খরচ চালানোর জন্য যথেষ্ট ছিল না। অতএব ইসমাঈলিয়ার সংগঠনই এখানকার ব্যয়ভারের একটা অংশ মিটানোর দায়িত্ব নিজদের কাঁধে তুলে নেয়।
পোর্ট সাঈদের সাংগঠনিক মজবুতি অর্জনের পর সেখানকার কর্মীরা দাওয়াতের কাজ সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তারা ১৩৪৭ হিজরীর মহররম মাসে একটি গণজমায়েতের ঘোষণা দেন। এটা ছিল ইখওয়ানের বড় আকারের প্রথম জনসভা। এতে সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন। এ জনসভার প্রধান বক্তা ছিলেন হাসানুল বান্না। কিন্তু তিনি ঐ দিন আকস্মিক গলা ব্যথায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন। স্কুলের পরিচালক ডাক্তার মাহমুদ বেগ বলেন, হাসানুল বান্না যদি দিনে ভ্রমণ ও রাতে বক্তৃতাদান অব্যাহত রাখেন তাহলে তিনি নিজের প্রতি অবিচার করবেন। এ সত্ত্বেও হাসানুল বান্না ভ্রমণের বিষয়ে দৃঢ় সংকল্প হয়ে বসেন। অবশ্য দুর্বলতার কারণে তিনি শুয়ে ভ্রমণ করেন। পোর্ট সাঈদ পৌঁছে ক্লান্তির কারণে তিনি বসে বসে নামায আদায় করেন।
নামায শেষ করার পর তিনি অদ্ভূত এক মানসিক অবস্থায় পড়ে যান। তিনি ভাবেন, পোর্ট সাঈদের ইখওয়ান কর্মীরা এই সমাবেশের ব্যাপারে কতটা উৎফুল্ল, লোকজনকে সমবেত করতে তারা জীবনপাত করে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। অথচ ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস প্রধান অতিথিই বক্তব্য দানে অপরাগ? এ সব বিষয় নিয়ে ভাবতে গিয়ে হাসানুল বান্না আকস্মিক কেঁদে ফেলেন এবং গভীর এক অচেতনতায় আচ্ছন্ন হয়ে এশার নামাযের পূর্ব পর্যন্ত আল্লাহ পাকের দরবারে সুস্থতা ও শক্তির জন্য ক্রন্দনরত অবস্থায় কাটিয়ে দেন। এ সময়ে তিনি নিজের মধ্যে কিছুটা সুস্থতা অনুভব করেন। তিনি দাঁড়িয়ে এশার নামায আদায় করেন। তিনি যখন বক্তৃতা দেয়া শুরু করেন তখন তিনি নিজেও শুনতে পাচ্ছিলেন না যে, তিনি কি বলছেন। কিন্তু ধীরে ধীরে তার মধ্যে শক্তি সঞ্চারিত হতে থাকে। মনে হয় যেন তিনি পূর্ণ আরোগ্য লাভে সক্ষম হয়েছেন। তার আওয়াজ সম্পূর্ণ পরিষ্কার ও গাম্ভীর্যপূর্ণ হয়ে উঠে। সামিয়ানার নীচে বসা লোকেরা যেমন শুনতে পাচ্ছেন তেমনি বাইরের লোকেরাও শুনতে পাচ্ছেন। এভাবে আল্লাহ পাকের সাহায্য ও মেহেরবানীতে সমাবেশের কাজ সুষ্ঠুভাবে সমাপ্ত হয়।
অধ্যায় ০৩ : কাফেলার অগ্রযাত্রা শুরু
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
রিসেন্ট ব্লগ পোষ্টস
বিষয়শ্রেণী
রাইটার
প্রিয়-ক্লিক
কিছু বই
- অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা
- অর্থনীতিতে রাসূল (সা) এর দশ দফা
- আদর্শ মানব মুহাম্মদ (সা)
- আসহাবে রাসূলের জীবনকথা
- ইসলাম ও জিহাদ
- ইসলাম পরিচিতি
- ইসলামী আন্দোলন : সাফল্যের শর্তাবলী
- ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক
- ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি
- ইসলামী দাওয়াত ও কর্মনীতি
- ইসলামী নেতৃত্বের গুণাবলী
- ইসলামী বিপ্লবের পথ
- ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন
- ইসলামী সমাজে মজুরের অধিকার
- একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণঃ তার থেকে বাঁচার উপায়
- চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান
- দায়ী’ ইলাল্লাহ - দা’ওয়াত ইলাল্লাহ
- নামাজ কেন আজ ব্যর্থ হচ্ছে
- নামায-রোজার হাকীকত
- মোরা বড় হতে চাই
- যাকাতের হাকীকত
- রাসূলুল্লাহর বিপ্লবী জীবন
- শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী ও তাঁর চিন্তাধারা
- সত্যের সাক্ষ্য
- হেদায়াত
0 comments: